
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের ভয়াবহ দৃশ্য আজ বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। শিশুদের আর্তনাদ, নারীদের বিলাপ এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহরগুলো প্রতিদিন মানবতার বিবেককে নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি করছে। বহু দেশ এই অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে; কেউ কেউ ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এবার সেই তালিকায় বড় পদক্ষেপ নিল তুরস্ক। শুধু কূটনৈতিক নয়, ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্ক সমস্ত অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে ঘোষণা দেন, ইসরাইল গত দুই বছর ধরে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে এবং মানবিক মূল্যবোধ উপেক্ষা করেছে। তাই তুরস্ক সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করছে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইসরাইলের কোনো বিমান তুরস্কের আকাশে প্রবেশ করতে পারবে না এবং কোনো জাহাজ ইসরাইলি বন্দরে ঢুকতে বা সেখান থেকে আসতে পারবে না। কার্যত ইসরাইলের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে তুরস্কের আকাশপথ ও সমুদ্রপথ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে তুরস্ক ও ইসরাইলের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার ছিল। তুরস্ক ইসরাইলকে রপ্তানি করত খাদ্যপণ্য, নির্মাণ সামগ্রী, শিল্পজাত যন্ত্রপাতি এবং টেক্সটাইল, আর ইসরাইল থেকে আমদানি করত প্রযুক্তি ও কেমিক্যাল পণ্য। যুদ্ধবিরতির দাবিতে তুরস্ক আগেই বাণিজ্যের কিছুটা সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল, তবে এবার পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় ইসরাইলের অর্থনীতি বড় সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি উভয় পক্ষের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইফ এরদোয়ান দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচক। তিনি একাধিকবার ইসরাইলি বাহিনীর কার্যকলাপকে গণহত্যা আখ্যা দিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতান্যাহুকে সরাসরি হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার ভাষায়, মানবতার প্রশ্নে কোনো আপোষ নেই। শিশু হত্যা, নারী হত্যা এবং একটি জাতিকে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণযোগ্য নয়।
তুরস্কের এই কঠোর সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের অনেকে এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও আরব দেশগুলোর একটি অংশ এখনও নীরব, জনমতের চাপ বাড়ছে। ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বে ভিন্নমত রয়েছে; কেউ এটিকে মানবিক অবস্থান হিসেবে দেখছে, কেউ মনে করছে অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে ইসরাইলকে থামানো কঠিন হবে। তবে নিঃসন্দেহে এই ঘোষণা নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের মাঝে নতুন আশা জাগিয়েছে। গাজায় প্রতিদিন শিশুদের লাশ উদ্ধার হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ থেকে, হাসপাতালে নেই ওষুধ, নেই বিদ্যুৎ; জাতিসংঘ এটিকে ভয়াবহ মানবিক সংকট বলে ঘোষণা করেছে।
এই বাস্তবতায় তুরস্কের বার্তা শুধুমাত্র এক দেশের বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা বিশ্বকে উদ্দেশ্য করে জানাচ্ছে যে মানবতার প্রশ্নে নিরপেক্ষ থাকা মানে গণহত্যাকে মেনে নেওয়া। ইসরাইলি গণমাধ্যমও বলছে, তুরস্কের এ সিদ্ধান্ত নেতান্যাহু সরকারের জন্য বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে; একদিকে গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চাপ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া। এখন প্রশ্ন, তুরস্কের এই উদ্যোগ কি অন্য মুসলিম দেশগুলোকে একই পথে হাঁটার জন্য অনুপ্রাণিত করবে, নাকি ইসরাইল পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন নিয়ে আগের মতোই আগ্রাসন চালিয়ে যাবে। তুরস্কের পদক্ষেপ প্রমাণ করে, আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশের বাইরে গিয়ে তারা এবার সরাসরি মানবতার পাশে দাঁড়াচ্ছে। এটি কেবল ইসরাইলের জন্য অর্থনৈতিক আঘাত নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক নৈতিক বার্তা, যে গণহত্যার সঙ্গে কোনোভাবেই বাণিজ্যিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক চলতে পারে না।