
প্রায় দুই দশক ধরে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদ্দিন আল-কাসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র হিসেবে রয়েছেন আবু উবাইদা। তার প্রকৃত পরিচয় গোপন থাকলেও তিনি হামাসের সবচেয়ে আলোচিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন। বিভিন্ন সময় হামাসের হয়ে বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিতে মুখোশ ও সামরিক পোশাক পড়ে সামনে আসেন তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্রের আপডেট প্রদান করেন, হামাসের সামরিক সাফল্য নিয়ে গর্ব করেন এবং ইসরায়েলকে কটূক্তি করেন। সম্প্রতি আইডিএফ দাবি করে যে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় অবস্থানকালে মৃত্যু হয়েছে হামাসের এই মুখপাত্রের। এরপরই বেশ আলোচনায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের এই শীর্ষ ব্যক্তিত্ব।
আবু উবাইদার খ্যাতি তাকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, তার বাড়িতে তিনবার বোমা হামলা হয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে তার ইসরায়েলি হামলায় উবাইদার মৃত্যুর বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি হামাস।
পরিচিতি ও উত্থান
২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে ইসরায়েলি অভিযানের বিষয়ে তথ্য দেন তিনি। এরপর থেকেই তিনি আল-কাসাম ব্রিগেডের প্রথম এবং একমাত্র আনুষ্ঠানিক সামরিক মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
আবু উবাইদা সবসময় সামরিক পোশাক ও লাল কেফিয়ায় মুখ ঢেকে উপস্থিত হন। এজন্য তাকে আরব বিশ্বে বলা হয় “মুখোশধারী”। এই ঐতিহ্য হামাসের প্রথম প্রজন্মের কমান্ডারদের কাছ থেকে এসেছে। আবু উবাইদার প্রধান দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো গ্রুপের সামরিক সাফল্য ঘোষণা করা।
তার প্রথম প্রধান উপস্থিতি ২০০৬ সালে এসেছিল, যখন তিনি ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতকে বন্দি করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় আরেক সেনা শাউল অ্যারনকে বন্দি করার ঘোষণা দেন এবং একটি রেকর্ড করা ভিডিওতে তার পরিচয়পত্র নম্বর প্রকাশ করেন।
গোপন পরিচয়
তার নাম, জন্মস্থান ও পরিবার নিয়ে কোনো সরকারি তথ্য প্রকাশ করেনি হামাস। ধারণা করা হয়, তিনি ১৯৮০’র দশকে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার পরিবার ১৯৪৮ সালে জায়োনিস্ট বাহিনীর হাতে বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজায় আশ্রয় নেন।
গাজা যুদ্ধ ও তার বার্তা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাস আক্রমণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনিই প্রথম বিস্তারিত তথ্য দেন। তিনি জানান, প্রায় সাড়ে চার হাজার সদস্য এ অভিযানে অংশ নেয়, যার মধ্যে তিন হাজার সদস্য মাঠে সরাসরি নিয়োজিত ছিল।
যুদ্ধ শুরুর দুদিন পর উবাইদা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, প্রতিটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলার জবাবে একজন ইসরায়েলি বন্দিকে হত্যা করা হবে। যদিও এ হুমকি বাস্তবায়িত হয়নি।
আরব বিশ্বের কাছে জনপ্রিয়তা
আজকের দিনে আবু উবাইদা শুধু হামাসের মুখপাত্র নন, বরং আরব বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে তিনি এক প্রতিরোধের প্রতীক। তার বক্তৃতা এখনো আরব বিশ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পর্যন্ত মানুষ শোনে।
এমনকি কাতারের সাবেক আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানিও এক ম্যাচ চলাকালে তার ভাষণ শোনেন। ফিলিস্তিন এবং ইরানের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচের সময় আবু ওবাইদার একটি বক্তৃতা কাতারের প্রাক্তন শাসক শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
ইসরায়েলের দৃষ্টিতে শত্রু
ইসরায়েল একাধিকবার তার বাড়ি বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে। ২০০৮, ২০১২ এবং ২০১৪ সালে তার বাড়ি ধ্বংস করা হয়। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে কয়েক দফা তার নাম ও ছবি প্রকাশ করা হলেও হামাস তা অস্বীকার করেছে।
আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা
২০২৪ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে “তথ্যযুদ্ধ বিভাগের প্রধান” আখ্যা দিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের দাবি, তিনি ইরানের সহায়তায় আল-কাসামের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু রেখেছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং আবু ওবাইদার কথিত কার্যকলাপ সম্পর্কে করা দাবি সম্পর্কে হামাস কোনও মন্তব্য করেনি।
কৌশলগত গুরুত্ব
হামাসের ভেতরে তার অবস্থান শুধু মুখপাত্রের নয়, তাকে অনেকেই কৌশলগত চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচনা করেন। ইসরায়েলও তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে টার্গেট করছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে এক ভাষণে তিনি আরব শাসকদের ব্যর্থতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। বিশেষ করে গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে না পারায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
নামের তাৎপর্য
“আবু উবাইদা” নামটি এসেছে ইসলামের ইতিহাসের সাহাবি ও খ্যাতনামা সেনাপতি আবু উবাইদা ইবনে আল-জাররাহ থেকে, যিনি নবী মুহাম্মদের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। যদিও তার জীবন, পরিচয় ও পরিণতি অনিশ্চিত, তবুও তার মুখোশ ও কণ্ঠস্বর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের ইতিহাসে এক অমোঘ ছাপ রেখে গেছে।