Image description
 

গত বছরের জুন মাসে নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। যদিও সেই নির্বাচনে তার দল বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি; কিন্তু তেলুগু দেশম বা জনতা দল ইউনাইটেডের মতো শরিকদের সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষেত্রে তার কোনো সমস্যাও হয়নি।

কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে তার শাসনকালের পনেরো মাস অতিক্রান্ত হতেই দেশের বিরোধী দলগুলো জোরেশোরে মোদির ইস্তফার দাবি করতে শুরু করে দিয়েছেন।

লোকসভায় বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী বেশ কিছুদিন ধরে বলেই চলেছেন, ২০২৪-এর যে সাধারণ নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন—সেই ভোটটা আগাগোড়া ভুলে ভরা একটা ভোটার তালিকার ভিত্তিতে হয়েছে। আর এই ‘ভুল’টা যে নির্বাচন কমিশনের ইশারাতেই ইচ্ছাকৃতভাবে করা, সেই ইঙ্গিত দিতেও তিনি কোনো দ্বিধা করছেন না।

 

বুধবার (২৭ আগস্ট) বিহারের মুজফফরপুরে এক নির্বাচনী সভা থেকে তিনি আরও অভিযোগ করেন, বৈধ ভোটারদের ভোট কেটে আর জাল ভোটারদের নাম তালিকায় যোগ করেই মোদি ভোটে জিতেছেন—আর এ কাজে তাকে সাহায্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আর দেশের নির্বাচন কমিশন।

 
 

কংগ্রেসের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতভেদ থাকলেও দেশের আর একটি বড় বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু এই প্রশ্নে রাহুল গান্ধীর পাশেই দাঁড়িয়েছে। ডিএমকে ও আরজেডির মতো দলগুলোরও সমর্থন পাচ্ছেন তিনি।

 

তৃণমূলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা অভিষেক ব্যানার্জী রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে দিনকয়েক আগেই বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যদি মেনেই নেয় দেশের ভোটার তালিকায় প্রচুর অসংগতি আছে এবং যেহেতু বর্তমান সরকার সেই তালিকার ভিত্তিতে করা ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে—তাহলে সেই সরকারের কোনো বৈধতা থাকতে পারে না।

‘সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তার গোটা মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা উচিত ও লোকসভা অবিলম্বে ভেঙে দেওয়া উচিত’—এই দাবিও তুলেছেন অভিষেক ব্যানার্জী।

বিরোধীদের তোলা এই ভোট চুরির অভিযোগ ক্রমশই ‘মোমেন্টাম’ পাচ্ছে, আর তা দৃশ্যতই অস্বস্তিতে ফেলছে মোদি সরকারকে।

বস্তুত একটানা এগারো বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, তবে এর আগে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আর কোনো বিষয় তাকে এতটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেনি।

ক্ষমতাসীন বিজেপি যদিও রাহুল গান্ধীর তোলা ভোট চুরির অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে; কিন্তু বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্যে ভোটার তালিকায় যে ব্যাপক সংশোধন (এসআইআর) দরকার, সে দাবিতেও সমর্থন জানাচ্ছে তারা।

জাতীয় নির্বাচন কমিশনও মেনে নিয়েছে, কোনো কোনো রাজ্যের ভোটার তালিকায় প্রচুর ভুয়া নাম আছে, সেগুলো বাদ দিতেই এসআইআর বা ‘বিশেষ নিবিড় পর্যালোচনা’ প্রয়োজন—সোজা কথায় তালিকায় কাটছাঁট করা দরকার।

বিহারে আগামী নভেম্বরেই ভোট হওয়ার কথা—তার আগে সে রাজ্যে কমিশনের পক্ষ থেকে যে এসআইআর চালানো হয়েছে তাতে প্রাথমিকভাবে ৬৫ লাখেরও বেশি ভোটারের নাম বাদ পড়েছে।

আর বিরোধীরা ঠিক এ কারণেই প্রশ্ন তুলছেন, বিহার বা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন তালিকা ভুল; কিন্তু মহারাষ্ট্র বা গুজরাটের ভোটার তালিকা নিখুঁত—এটা কীভাবে হতে পারে?

বস্তুত ২০২৪-এ ভারতের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার ভিত্তিতে—এই ধারণা যতই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততই আসলে নরেন্দ্র মোদির ইস্তফার ও লোকসভা ভেঙে দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে!

ভারতের লোকসভায় শক্তির বিচারে কংগ্রেসের পরই যে বিরোধী দলগুলোর অবস্থান—সেই ডিএমকে, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি ও আরজেডি প্রত্যেকেই রাহুল গান্ধীর এই ভোট চুরির অভিযোগে সমর্থন জানাচ্ছে।

বুধবার মুজফফরপুরের সমাবেশে ডিএমকে নেতা ও তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী স্টালিনও উপস্থিত ছিলেন, তিনি রাহুল গান্ধীর তোলা প্রতিটি অভিযোগেই সায় দিয়েছেন।

তা ছাড়া বিহারে কংগ্রেসের ভোটার অধিকার যাত্রায় আগাগোড়াই রাহুল গান্ধীর সঙ্গে আছেন আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব, যার দল রাজ্যে কংগ্রেসের জোটসঙ্গীও বটে।

এদিকে তৃণমূল নেতা অভিষেক ব্যানার্জী এর আগেই দাবি করেছেন, ভোটার তালিকায় ‘এসআইআর’ যদি করতেই হয়, তাহলে নির্দিষ্ট একটি বা দুটি রাজ্যে নয়—গোটা দেশেই সেটা করতে হবে আর সেই প্রক্রিয়ার সূচনা হতে হবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে।

‘নির্বাচন কমিশন বলছে ভোটার তালিকায় অসংগতি ছিল, তাই এসআইআর দরকার। বেশ, তাহলে শুধু বিহারে বা পশ্চিমবঙ্গে কেন—গোটা দেশেই তালিকা সংশোধন হোক এবং লোকসভা ভেঙে দেওয়া হোক’, প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

এই ভোটার তালিকার ভিত্তিতেই যে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তার দলের ২৪০ জন এমপি লোকসভায় নির্বাচিত হয়ে এসেছেন—আর তারাই দেশের প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করছেন—সেটাও মনে করিয়ে দেন অভিষেক ব্যানার্জী।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফার দাবিকে আমলই দিচ্ছে না। বিজেপির মুখপাত্র শাহনাজ পুনেওয়ালা এদিন রাহুল গান্ধীর ‘গুজরাট মডেলে’ ভোট চুরির দাবিকে নস্যাৎ করে পাল্টা দাবি করেছেন, নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তার মধ্যে বেশিটা সময়ই—২০০৪ থেকে ২০১৪ কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় ছিল।

তখন নির্বাচন কমিশনারদেরও নিযুক্ত করেছিল কংগ্রেস সরকার। তো রাহুল গান্ধী কি বলতে চাইছেন তাদের আমলের কমিশনাররাই গুজরাটে মোদিজিকে ভোট চুরি করিয়ে জিতিয়েছেন? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তিনি।

বিজেপি নেতা আর পি সিং আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম এস গিলকে অবসরের পর কংগ্রেসই এমপি করে এনে মনমোহন সিংয়ের ক্যাবিনেটে মন্ত্রী বানিয়েছিল।

ওদিকে বর্তমান নির্বাচন কমিশন এর আগে গত ১৭ আগস্ট সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করেছিল, পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে রাহুল গান্ধী তার অভিযোগের স্বপক্ষে নিয়মমাফিক হলফনামা পেশ না করলে তারা ধরে নেবে সেই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।

সেই সময়সীমা এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে—রাহুল গান্ধী হলফনামাও দেননি বা ক্ষমা চেয়ে অভিযোগও প্রত্যাহার করেননি এবং কমিশন স্পষ্ট করে দিয়েছে তার তোলা অভিযোগগুলো নিয়ে কোনো তদন্ত হবে না।

কিন্তু রাজনৈতিকভাবে নরেন্দ্র মোদি সরকার ও বিজেপি বিরোধীদের দিক থেকে আসা এই শক্ত চ্যালেঞ্জকে কীভাবে মোকাবিলা করে, সেটাই এখন দেখার।

সূত্র : বিবিসি বাংলা