
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা প্রায় ২০০-তে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) জানিয়েছে, সাংবাদিকদের জন্য গাজার এই সঙ্ঘাত ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ। খবর : আলজাজিরা, রয়টার্স ও বিবিসির।
সবশেষ উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলের শহর খান ইউনুসের নাসের হাসপাতালে ইসরাইলি হামলায় পাঁচজন সাংবাদিক নিহত হন। যারা রয়টার্স, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি), আলজাজিরা ও মিডল ইস্ট আইয়ের সাথে কাজ করছিলেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বিবিসি জানায়, প্রথম দফা হামলার পর যখন উদ্ধারকর্মীরা আহতদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন, তখনই দ্বিতীয় দফা হামলা চালানো হয়। এতে চার স্বাস্থ্যকর্মীও প্রাণ হারান। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘটনাটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ভুল’ আখ্যা দিয়েছেন এবং ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত’ করার আশ্বাস দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দা : জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা সঙ্ঘাতের মধ্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।’ তিনি দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের হত্যার মাধ্যমে দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া শিশুদের খবর পৌঁছে দেয়ার শেষ কণ্ঠও স্তব্ধ করা হচ্ছে।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখ্রোঁ বলেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে বেসামরিকদের ও সাংবাদিকদের সুরক্ষিত রাখতে হবে।’ কাতার, কানাডা, ইরান, সৌদি আরব, এমএসএফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা হামলার নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস আহ্বান জানিয়েছে, ইসরাইলকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা বন্ধ করতে হবে। জেরুসালেমভিত্তিক ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনও জানিয়েছে, সাংবাদিকদের সরাসরি লক্ষ্য করে হামলা চালানো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন।
হামলার প্রেক্ষাপট ও ঘটনার বিবরণ : নাসের হাসপাতালে হামলার প্রথম দফা হাসপাতালের ওপরতলায় পরিচালিত হয়, যেখানে অপারেশন থিয়েটার ও চিকিৎসকদের আবাসিক কক্ষ ছিল। আহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা লাইভ সম্প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে দ্বিতীয় দফা হামলা চলে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন এপির ৩৩ বছর বয়সী ভিজ্যুয়াল সাংবাদিক মারিয়াম দাগ্গা, যিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজার স্বাস্থ্য খাতে মানবিক বিপর্যয় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করে আসছিলেন।
ইসরাইলি সেনারা দাবি করেছেন, তারা সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করেননি। হামাস বরাবরই বেসামরিক জনগণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বলে সেনারা দাবি করেছেন। তবে নিহতদের মধ্যে চিকিৎসক ও সাংবাদিক থাকায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, প্রথম হামলায় হাসপাতালের একাংশ ধ্বংস হয় এবং দ্বিতীয় হামলায় সিঁড়ি ও আশপাশে থাকা মানুষজন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নিহত ২০ জনের পাশাপাশি প্রায় ৮০ জন আহত হয়েছেন, অনেকে হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
অনাহার, অপুষ্টি ও মানবিক সঙ্কট : গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় অনাহার ও অপুষ্টির কারণে মৃতের সংখ্যা ৩০৩-এ পৌঁছেছে, যার মধ্যে ১১৭ শিশু। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৭৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, ত্রাণ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ১৭ জন। গাজার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মারাত্মক। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, জরুরি ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রী অনিয়মিতভাবে পৌঁছাচ্ছে। মানবিক সংস্থা এমএসএফ সতর্ক করেছে, অবিলম্বে সহায়তা পৌঁছানো না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
গাজায় তৎপর ইসরাইলি বাহিনী : ইসরাইলি সেনারা গাজার শহরের কেন্দ্রে প্রবল শক্তি নিয়ে অভিযান চালাচ্ছে। ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে তারা পুরো ব্লকগুলো ধ্বংস করছে, যা শুধুমাত্র ভবন ধ্বংসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাসিন্দাদের সরাতে এবং আবাসিক এলাকা খালি করার উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে। পূর্ব গাজার শহরের অংশে আর্টিলারি ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যা নাগরিক অবকাঠামো ধ্বংস করছে। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সিভিলিয়ান স্থাপনা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
সেনাবাহিনী আপাতত নিখুঁত আঘাতের পরিবর্তে শহরের অবশিষ্ট নগর কাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংসের কৌশল নিচ্ছে। এই ধ্বংসযজ্ঞে পরিবারগুলো স্থায়ীভাবে চলাচলের জায়গা হারাচ্ছে। নাগরিকরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন না, ফলে মানবিক বিপর্যয় আরো তীব্র হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরাইলি সেনাদের এই কৌশল শুধুমাত্র সামরিক লক্ষ্য নয়, বরং গাজার শহরের নানাবিধ নগর অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে উজাড় করার দিকে লক্ষ্য রাখছে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ বেসামরিক হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই ধ্বংসযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা ইসরাইলকে সিভিলিয়ান এলাকা ধ্বংস বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে এবং নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার দাবি তুলেছে। গাজার বসতি ও শহর অবকাঠামো রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা এখন অতিশয় জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা : ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে গাজার যুদ্ধবিরতির দাবিতে বিক্ষোভ চলমান রয়েছে। আন্দোলনকারীরা হামাসের হাতে আটক বন্দীদের মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি চাওয়ার জন্য সমাবেশ করছেন। ইসরাইলের প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে বিক্ষোভকারীরা আগুন জ্বালিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন।
এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে গাজার যুদ্ধের চূড়ান্ত সমাধি হবে। তিনি জানিয়েছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধ শেষ করা জরুরি হলেও মানুষ ৭ অক্টোবরের হামলাকে কখনো ভুলবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংবাদিক সংগঠনগুলো আশঙ্কা করছে, চলমান সঙ্ঘাতে চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মানবিক বিপর্যয় আরো বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে চাপ বাড়লেও বাস্তবিক পদক্ষেপ নেয়া এখনো সীমিত। এভাবে গাজার সাম্প্রতিক হামলা ও তার প্রভাব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, জাতিসঙ্ঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো তীব্রভাবে নজর রাখছে।