Image description

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক-প্রকাশক মাহফুজ আনাম মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে গণতন্ত্র নেই।’ তিনি গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে ‘ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ দেখেছিলেন। তবে গঠিত হওয়ার প্রায় পাঁচ-ছয় মাস পর নবীন রাজনৈতিক দল এনসিপির বিষয়ে মাহফুজ আনামের পর্যবেক্ষণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আওয়ামী লীগের প্রতি তার সমালোচনা এখনো আগের মতোই কঠোর, বিএনপির প্রতি তার সন্দেহ বেড়েছে। জামায়াতের বিষয়ে তার মন্তব্য 'সহনশীল'।

নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের 'আজীবন শুভাকাঙ্ক্ষী' ঘোষণা দেওয়া মাহফুজ আনামের সরকারপ্রধানের প্রতি তার এক বছরের সরকার পরিচালনার পর আরো বেড়েছে। ডেইলি স্টারে নিজের লেখা সবশেষ কলামে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তার মতে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এনসিপি 'জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের' প্রণীত 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নের যে দাবি তুলেছে, তাদের এই দাবি অসাংবিধানিক আবদার। এটা একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে। দলটির নেতারা জনস্বার্থের বদলে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত ডেইলি স্টারের এক উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমাদের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নিয়ন্ত্রিত হয় পরিবারতন্ত্রের ধারায়। দলের ভেতরে কোনো ধরনের গণতন্ত্র নেই। দলীয় পদ-পদবি কারা পাবে, তা এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন, কোনো নির্বাচন নেই।’ তার মতে, ‘জামায়াতই একমাত্র দল, যারা তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব নির্বাচনের কাঠামো অনুসরণ করে।’ গত ২২শে আগস্টে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় পড়ে পাঠকেরা উপলব্ধি করতে পারেন, জামায়াতের বিষয়ে মাহফুজ আনামের পর্যবেক্ষণে পরিবর্তন ঘটেনি।

২২শে আগস্ট মাহফুজ আনামের উপসম্পাদকীয় 'পলিটিক্যাল পার্টিস মাস্ট সাপোর্ট দ্য ইলেকশন ড্রাইভ' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এটিই তার লেখা এখনো পর্যন্ত সবশেষ কলাম। এতে তিনি এনসিপির উদ্দেশ্যে বলেন, 'এই দাবি বা ওই দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হতে পারে না'—এমন কথা বলার অধিকার কোনো দলেরই নেই। ভোটারদের তাদের মৌলিক ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার কারও নেই। এটি সর্বোচ্চ মৌলিক অধিকার এবং প্রত্যেক নাগরিক জন্ম থেকেই এর অধিকারী। ভোট হলো নাগরিকদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রতীক।'

তিনি লেখেন, ''তারা (এনসিপি) নির্বাচনের দিনক্ষণ মেনে নিলেও, নির্বাচনের আগে 'জাতীয় ঐকমত্য কমিশন' প্রণীত 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। তারা চায়, সংবিধান বা যেকোনো আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে জুলাই সনদ। তাদের এই দাবি একটি অসাংবিধানিক আবদার। এটা একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে। তাই এ ব্যাপারে বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের তোলা প্রশ্নকে আমরা যৌক্তিক বলেই মনে করি। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন—রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার একটি দলিল কি সংবিধানের ওপর স্থান পেতে পারে?''

তিনি বলেন, 'এনসিপিও পিআর দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সদ্য গঠিত হওয়ায় দলটির কোনো নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নেই। তাদের ধারণা, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তারা হয়তো কয়েকটি বাড়তি আসন পাবে। এখানেও তারা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখছে।' গত মার্চ মাসে এক উপসম্পাদকীয়তে তিনি দাবি করেছিলেন, 'এনসিপি ইতোমধ্যেই সবার মাঝে ব্যাপক আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে না হলেও ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের।’

বিএনপির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা কিংবা জনগণের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে বিএনপির আগ্রহ নেই, বরং তারা পরিস্থিতির সুবিধা নিতে নির্বাচন চাইছে। দলটির নেতাদের ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে, তাদের জন্য ততই মঙ্গল। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে—দলটির আশঙ্কা—ততই তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। কারণ, তাদের কিছু নেতাকর্মী ইতিমধ্যে এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, যা আগের ক্ষমতাসীন দলের জন্য বদনামের কারণ হয়েছিল।'

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার কোনো লক্ষ্মণ ও সুযোগ এখনো পর্যন্ত দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। জাতীয় নির্বাচনের আলোচনায় নেই আওয়ামী লীগ। কিন্তু সামনের সংসদ নির্বাচন বিষয়ে মাহফুজ আনামের ২২শে আগস্টের লেখায় হাজির হয়েছে আওয়ামী লীগের সমালোচনা। তিনি বলেন, 'নির্বাচনে কারচুপি করা ছিল শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় অপরাধগুলোর একটি। তিনি কেবল জালিয়াতির নির্বাচন করেননি, বরং গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছেন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন এবং নির্বাচনকে সন্দেহ করার মতো একটি ব্যাপারে পরিণত করেছেন, অথচ যেটা কিনা জনমত বোঝার যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।'

তিনি লেখেন, ''পরপর তিনবার এই কাজ করার মাধ্যমে পূর্ববর্তী সরকার সংসদকে একটি 'রাবার স্ট্যাম্প' প্রতিষ্ঠানে এবং সংসদ সদস্যদেরকে আজ্ঞাবহ কর্মচারীতে পরিণত করেছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমপিরা উন্নয়ন তহবিল আত্মসাৎসহ বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে তাদের দলীয় প্রধানের ইচ্ছা পূরণ করতেন। নির্বাহী বিভাগের ওপর তদারকি করার পরিবর্তে তার 'অনুগত সেবক' হয়ে গিয়েছিল সংসদ।''

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ‘আজীবন শুভাকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন ডেইলি স্টারের প্রকাশক মাহফুজ আনাম। গত ১৮ই এপ্রিল ডেইলি স্টারে 'আনহেলদি ইলেকশন কন্ট্রুভার্সি মাস্ট বি রিসলভড' শিরোনামে প্রকাশিত এক কলামে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ দেশের আর কোনো সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের কোনো সরকারের পক্ষে কলাম লিখে এভাবে ঘোষণা দেওয়ার নজির নেই। গত এক বছরে সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণেও ড. ইউনূসের সরকারের প্রতি মাহফুজ আনামের শুভকামনার কমতি নেই।

তিনি গত ২২শে আগস্টে প্রকাশিত কলামে লেখেন, 'নিঃসন্দেহে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের পদের জন্য যোগ্যতম। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের জায়গায় এখন এমন একটি নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়া অপরিহার্য, যে সরকার জনগণের স্বাধীন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ক্ষমতায় আসবে।'