
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলাটি ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এই সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করেছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা। মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরা এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এবং দৈনিক প্রথম আলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে জানিয়েছেন ঘটনাটির পর্যবেক্ষকরা।
খুনি হাসিনার পূর্বপরিকল্পিত এই হামলার প্রমাণ হিসেবে বেশ কয়েকটি তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। আওয়ামী লীগ প্রথমে মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু তারা গোপনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এটি করার পরিকল্পনা করে। বলা হয়, পুলিশ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা যাতে না দিতে পারে এবং সেই ফাঁকে নীল নকশা বাস্তবায়ন করা যায় সেজন্যই আগথেকেই ওই পরিকল্পনা এঁটে রেখেছিল আওয়ামী লীগ।
জানা যায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট মুক্তাঙ্গনে বিক্ষোভ-সমাবেশ আয়োজনের অনুমতি চেয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের প্যাডে ডিএমপির কাছে আবেদন করেছিল আওয়ামী লীগ। যথারীতি ডিএমপি থেকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী মুক্তাঙ্গনে যথাযথ নিরাপত্তা তল্লাশি ও নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল। পত্র-পত্রিকাতেও সংবাদ ছাপা হয়েছিলো যে, আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে মুক্তাঙ্গনে। কিন্তু সমাবেশ শুরুর মাত্র ২ঘণ্টা আগে সমাবেশস্থল পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়।
আরও জানা যায়, হামলার মূল আসামি মুফতি হান্নানকে ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার গ্রেফতার করে। তারপর সে তার প্রতিটি জবানবন্দিতেই বলেছে, দুইদিন আগেই (১৯ আগস্ট) বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে টার্গেট করে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
গুরুত্বপূর্ণ এসব উদঘাটনকে ঘিরে বিশ্লেষকরা কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যেখানে সমাবেশ শুরুর ২ঘণ্টা আগেও জানতো না সমাবেশ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে হবে, সেখানে মুফতি হান্নান কিভাবে দুইদিন আগেই জানতে পেরেছিল যে, সমাবেশ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত হবে? কার সিদ্ধান্তে সমাবেশস্থল মুক্তাঙ্গন থেকে সরিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে নেয়া হয়েছিল? মুফতি হান্নানকে এই তথ্যটি কে সরবরাহ করেছিল?
অন্যদিকে, ২১ আগস্টের মর্মান্তিক গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত মামলায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই বিএনপি এবং তারেক রহমানকে জড়ানো হয়। আর এটিই প্রমাণ করে গ্রেনেড হামলাটি ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা।
গত ডিসেম্বরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এই রায় দেওয়া হয়। ফলে এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ দণ্ডিত সব আসামি খালাস পায়।
মামলা ও ঘটনার পর্যবেক্ষণেল উঠে এসেছে, অসংখ্য গ্রেনেড ছোড়া হলেও শেখ হাসিনা যে ট্রাকে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সেটিতে সরাসরি কোনো গ্রেনেড আঘাত করেনি। হামলার আগে মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এসে দাঁড়াতে বলেন তিনি। অথচ কখনও এভাবে নেতাকর্মীদের শরীর ঘেঁষে দাঁড়াতে বলা হয়নি। ফলে এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, হামলাকারীরা হাসিনার প্রতি অনুগত ছিল এবং তাদের পরিকল্পনা ছিল তাকে এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের নিরাপদ রাখা।
এছাড়া, আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত এই হামলার ঘটনায় আরেকটি প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনা কেবল কানের নিচে সামান্য আঘাত পেয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন কিভাবে? ফলে প্রমাণিত হয়, হামলাটি তাকে আঘাত না করার জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে।
ঘটনাটির পর্যবেক্ষকরা আরও জানান, শেখ হাসিনা আইভি রহমানের মৃত্যুতে গোপনে আনন্দিত হয়েছিলেন। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার পরোকিয়ার সম্পর্কের কারণে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল।
গ্রেনেড হামলার তদন্তে উঠে আসে, শেখ হাসিনা পালানোর সময় তার গাড়িতে গুলি করা হয়েছিল। এফবিআই এবং মার্সিডিজ-বেঞ্জ গাড়িতে থাকা গুলির চিহ্ন নিয়ে প্রশ্ন গুরুতর উঠলে আওয়ামী লীগকে আদালতে গাড়িটি উপস্থাপন করতে বলা হয়। কিন্তু তারা সেটি পুড়িয়ে ফেলে বলে জানা যায়।
এদিকে, দৈনিক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মিথ্যাভাবে জজ মিয়াকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাসহ পূর্বের ফৌজদারি রেকর্ড থাকা স্বত্বেও নির্দোষ প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পত্রিকাটি।
উল্লেখ্য, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় আহত হন আইভি রহমান। স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত আইভি ঘটনার ৪ দিন পর মারা যান। তার পারিবারিক নাম জেবুন্নেছা, রাজনীতির মাঠে আইভি রহমান নামেই জনপ্রিয়। ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব শহরের চন্ডিবের গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম। রাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি শেখ মুজিবের সঙ্গে আইভি রহমানের ছিল নিবিড় সখ্যতা। মুজিবের সাথে এই ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেই ১৯৬৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান আইভি। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের সঙ্গে পরিণয় হয় ১৯৫৮ সালে।
এ ঘটনায় করা মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।