Image description
 

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস আগে হোয়াইট হাউস সাক্ষী হয় অনাকাঙ্খিত এক মুহুর্তের। যেখানে বাগবিতণ্ডায় জড়ান দুটি রাষ্ট্রের প্রধান। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে একটি দেশের সরকার প্রধানকে রীতিমতো বাধ্য করা হয় হোয়াইট হাউস ছাড়তে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় হিসেবে দিনটি ছিল শুক্রবার। বলা চলে বেশ আশা নিয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সেদিন বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিন্তু উল্টো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর সম্ভাব্য কুশিলব অ্যাখ্যা পেয়ে বেরিয়ে আসতে হয় তাঁকে। সেদিন শুধু ট্রাম্প নন, জেলেনস্কিকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও। 

 
 

প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর সেই একই স্থানে আবার ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন জেলেনস্কি। তবে এবার তিনি একা নন। বৈঠকে তাঁর সমর্থনে থাকবেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধানসহ কয়েকটি দেশের সরকার প্রধান। এবার কী অপেক্ষা করছে জেলেনস্কি তথা ইউক্রেনের ভাগ্যে?

 

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে বৈঠকের একটি মুহুর্ত। ছবি: সংগৃহীত

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে বৈঠকের একটি মুহুর্ত। ছবি: সংগৃহীত

 

বিবিসি, সিএনএন ও নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, এবারের বৈঠক ইউক্রেন ও ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠকের চেয়েও হোয়াইট হাউসের বৈঠক বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে যাচ্ছে।

আলাস্কার বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা তথ্যের ভিত্তিতে অনেক বিশ্লেষক বলেন, বৈঠকটি ছিল অন্তঃসারশূন্য। যদিও পরে কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিবেদনে জানায়, বৈঠকে ট্রাম্পের কাছে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছেন পুতিন। এই দুই অঞ্চলে ইউক্রেন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল ডনবাস অবস্থিত। যেটি হাতছাড়া করার প্রস্তাব বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে কিয়েভ ও ইউরোপীয় মিত্ররা।

বৈঠকে কী হতে পারে
ট্রাম্পের সঙ্গে এবারের বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন ইউরোপের সাত শীর্ষ নেতা। হোয়াইট হাউসে তারা কোন বিষয়ে জোর দিয়ে আলোচনা করতে পারেন সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় রোববারের একটি বৈঠক থেকে। ট্রাম্পের সঙ্গে বসার আগে ওই বৈঠক করেন ইউক্রেনের মিত্র দেশ ও সংগঠনের সরকার প্রধানরা। সেখানে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার চাপ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি একটি নীতিগত সিদ্ধান্তে সবাই পৌঁছান যে, ইউক্রেনই তার ভূখণ্ডের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।  

ইউরোপীয় নেতারা চাইছেন, তাদের মতো করে ডোনাল্ড ট্রাম্পও রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিক। বৈঠকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ উল্লেখ করেন, ভবিষ্যতে নতুন সংঘাত এড়াতে ইউরোপকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর থাকতে হবে। ইউরোপ ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার দায়িত্ব নিতেও প্রস্তুত। বক্তব্যে মাখোঁ আরও উল্লেখ করেন, ইউরোপ এখন কূটনীতির নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। যেখানে ইউরোপীয় স্বার্থ রক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। 

 

হোয়াইট হাউসে এবারের বৈঠকে ইউরোপীয় নেতাদের পাশে পাচ্ছেন জেলেনস্কি। ছবি: সংগৃহীত

হোয়াইট হাউসে এবারের বৈঠকে ইউরোপীয় নেতাদের পাশে পাচ্ছেন জেলেনস্কি। ছবি: সংগৃহীত

 

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেন, ইউক্রেনকে একটি সজারুর মতো করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে আগ্রাসী কেউ এটিকে গিলতে না পারে। বৈঠকে উরসুলা ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ‘জীবন-মরণ রক্ষার’ মতো করে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। পাশাপাশি বলেন, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর কোনো সীমাবদ্ধতা প্রয়োগ করা যাবে না।

আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইউক্রেনের প্রতি তাঁর সমর্থন যতদিন প্রয়োজন হবে ততদিন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

ইউরোপীয় নেতাদের এমন বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, হোয়াইট হাউসের বৈঠকে তাঁরা ইউক্রেনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেবেন। এগুলোতে ট্রাম্পকে রাজি করানোর বিষয়েও তৎপরতা চালাবেন। বিশেষ করে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মনোভাবকে আবারও জাগাতে চাইবেন। যেমন, দ্য টেলিগ্রাফকে ইউরোপীয় এক কর্মকর্তা বলেছেন, আলোচনায় যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গ সামনে আনা হবে। এটি করতে ইউরোপীয় নেতারাও সম্মত হয়েছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কৌশলকে যুদ্ধবিরতির সেরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চান। 

যদিও এমন কৌশল কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার অর্থনীতি ও যুদ্ধযন্ত্রে অর্থায়নের ক্ষমতা ভেঙে ফেলার জন্য নতুন নিষেধাজ্ঞা যে শান্তি বয়ে আনবেই তা নিশ্চিত নয়।

বিবিসি বলছে, ইউরোপের নেতারা মূলত ট্রাম্প-পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রভাব যুদ্ধবিরতির আলোচনার মাঠে আনতে চান না। বিশেষ করে পুতিন ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যে দাবি জানিয়েছেন, তাতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুরুত্ব দিয়ে ট্রাম্প যেন রাজি না হন। এক্ষেত্রে ইউরোপ ইউক্রেনের প্রতি তাঁদের দৃঢ় সমর্থনের বিষয়টি ট্রাম্পকে উপলব্ধি করাতে চাইবে।

ট্রাম্প যা করতে পারেন
বৈঠক শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। নিজের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে কিছু ইচ্ছা ত্যাগ করতে হবে। বিশেষ করে ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধার ও ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বাসনা। 

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈঠকে বসার আগে ট্রাম্প যেসব শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন তা আলাস্কা বৈঠকে ভ্লাদিমির পুতিনের দেওয়া প্রস্তাবের মতোই। বৈঠকে পুতিন দাবি করেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে ইউক্রেনকে দোনেৎস্ক অঞ্চল হস্তান্তর করতে হবে। দোনেৎস্কে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল ডনবাসের একাংশ অবস্থিত।

 

গত শুক্রবার আলাস্কায় বৈঠক করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

গত শুক্রবার আলাস্কায় বৈঠক করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

ট্রাম্পের সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে ধারণা পাওয়া যায় তাঁর দূত স্টিভ উইটকফের বক্তব্যে। সিএনএনকে তিনি বলেছেন, সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিন একটি ‘মজবুত’ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা অনুমোদন দিয়েছেন। এটির আওতায় ইউক্রেনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। অর্থ্যাৎ, শান্তি চুক্তির পরও রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যৌথভাবে কিয়েভকে প্রতিরক্ষা সুরক্ষা দেবে। উইটকফ আরও বলেন, এই প্রতিশ্রুতির আওতায় রাশিয়া ভবিষ্যতে ইউক্রেন কিংবা অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে আক্রমণ করবে না।

 

উইটকফ বলেছেন, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। তবে শান্তি চুক্তিতে রাজি হলে ন্যাটোর আর্টিকেল-৫ মেনে ইউক্রেনকে সুরক্ষা দেওয়া হবে। 

ন্যাটোর আর্টিকেল-৫ হলো জোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা। যেটিকে সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বলা হয়। এর অধীনে বলা আছে- যেকোনো সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণকে সব সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হবে। এবং সবাই একসঙ্গে প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেবে।

ইউক্রেন বারবার এ ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চেয়ে আসছে। যেটি পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারে আভাস মিলতে পারে হোয়াইট হাউসের এবারের বৈঠকে।