Image description

ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের পর গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা তৎপরতার জটিল প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করেই একটি নাম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে—সামের হুলিলেহ।

কয়েকদিন ধরে ফিলিস্তিনি মহলে সংবাদ শিরোনাম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম—অতীতের অর্থনৈতিক ভূমিকায় নয়, বরং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য এক পদে—গাজার শাসক হিসেবে, যাকে নাকি কিছু দেশ যুদ্ধ থেমে গেলে বসাতে চায়।

ইসরাইলের দৈনিক ইয়েদিওথ আহরোনোথ–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়—আরব, ইসরাইল ও মার্কিন সমর্থনে (এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে) যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার ‘গভর্নর’ হিসেবে হুলিলেহকে বসানোর বিষয়ে গোপন আলোচনা চলছে।

খবরে দাবি করা হয়, এই ধারণা ‘গুরুত্বের সাথে আলোচিত’ হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হুলিলেহ নামটি অনেক ফিলিস্তিনির কাছে প্রতীক হয়ে ওঠে এক গভীর আশঙ্কার—বিদেশি শক্তিগুলো গাজার পরবর্তী নেতা নিজেরাই মনোনীত করতে চাইছে।

৬৭ বছর বয়সী হুলিলেহ বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেননি। ফিলিস্তিনি রেডিও আজিয়াল-এ তিনি জানান, মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করা এক কানাডীয় মধ্যস্থতাকারী যুদ্ধ শেষে গাজার প্রশাসন পরিচালনার বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে তিনি ‘কয়েকবার’ কথা বলেছেন এবং শর্ত দিয়েছেন—ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়া তিনি কোনো পদ নেবেন না। কিন্তু এই আশ্বাসই উল্টো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা ওয়াফা প্রেসিডেন্টের পক্ষে এক তীব্র বিবৃতি দিয়ে এমন পরিকল্পনায় কোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে।

বিবৃতিতে হুলিলেহকে ‘মিথ্যা বলার’ এবং গাজাকে অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার ‘ইসরাইলি ষড়যন্ত্রে’ ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে জড়ানোর অভিযোগ আনা হয়—যা অধিকাংশ ফিলিস্তিনির কাছে একটি নিষিদ্ধ সীমারেখা।

শিক্ষাঙ্গন থেকে ব্যবসার শীর্ষপদে

১৯৫৭ সালে জেরিকোতে জন্ম নেওয়া হুলিলেহ ১৯৮১ সালে বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান ও মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন বিষয়ে স্নাতক এবং ১৯৮৩ সালে বেইরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতায় এবং বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ ডিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

অসলো চুক্তির সময় তিনি ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনায় যুক্ত হন। ২০০০-এর দশকে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহকারী উপসচিব, ফিলিস্তিনি সরকারের মহাসচিব এবং ফিলিস্তিনি অর্থনৈতিক নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি প্যাডিকো হোল্ডিংয়ের (PADICO) সিইও হন এবং ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ফিলিস্তিন স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ছিলেন।

হুলিলেহর নেটওয়ার্ক উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক মহল জুড়ে বিস্তৃত। তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফিলিস্তিনি-আমেরিকান বিলিয়নিয়ার বাশার আল-মাসরি—রাওয়াবি সিটির উন্নয়নকারী—যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে পশ্চিম তীরের উন্নয়ন প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত।

এই সম্পর্কের জাল এখন গাজার পুনর্গঠন ও ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থায় সম্ভাব্য প্রভাব হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, হুলিলেহকে বসানোর লবিং করছেন আরি বেন-মেনাশে—ইরানজন্মী সাবেক ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ১৯৮০–এর দশকের ইরান–কনট্রা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে কানাডায় বসবাসরত বেন-মেনাশে জিম্বাবুয়ে থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিতর্কিত সরকারগুলোর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।

মার্কিন বিচার বিভাগে দাখিল করা নথি অনুযায়ী, কয়েক মাস আগেই বেন-মেনাশে হুলিলেহর পক্ষে লবিস্ট হিসেবে নিবন্ধিত হন, যার উদ্দেশ্য ছিল ওয়াশিংটনের সমর্থন পাওয়া।

প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় রয়েছে—গাজায় মার্কিন ও আরব বাহিনী মোতায়েন, উপকূলীয় এ অঞ্চলকে জাতিসংঘ স্বীকৃত বিশেষ মর্যাদা দেওয়া, সিনাই উপদ্বীপের কিছু অংশ বন্দর ও বিমানবন্দরের জন্য ভাড়া নেওয়া, এবং গাজার উপকূলবর্তী গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান অধিকার দেওয়া।

বেন-মেনাশে ইসরাইলি অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট শোমরিম-কে বলেন, এই পরিকল্পনা “শুধু রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, বরং ইহুদিদের জন্যও ভালো কিছু,” এবং মিশর ও সৌদি আরব এতে গ্যারান্টর হবে।

প্রত্যাখ্যান ও গভীর অবিশ্বাস

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দ্রুত জানায়, আনুষ্ঠানিক সরকারি কাঠামোর বাইরে কোনো গভর্নর নিয়োগের বিষয় তারা মেনে নেবে না।

হামাস আরো কঠোর প্রতিক্রিয়া জানায়। আন্দোলনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা দ্য নিউ আরবকে বলেন, এটি গাজায় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অভিভাবকত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অংশ। একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি জনগণ স্বাধীনতার জন্য বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছে, তারা বাইরের চাপিয়ে দেওয়া শাসক মেনে নেবে না।

তিনি বলেন, এসব প্রকল্প দখলদারের স্বার্থে কাজ করে এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন গভীর করে, জোর দিয়ে বলেন—গাজার প্রশাসন জাতীয় ঐকমত্য ও মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে হবে, বিদেশি রাজধানীর চুক্তি দিয়ে নয়।

রামাল্লার রাজনৈতিক বিশ্লেষক সামের আনাবতাওয়ি সতর্ক করে বলেন, গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে কৌশলগত বিপদ। গাজার জনগণের কোনো বিদেশি অভিভাবকত্ব বা মনোনীত নেতার দরকার নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিরাস ইয়াঘি মনে করেন, গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে আলাদা করে পরিচালনার যেকোনো পরিকল্পনা ইসরাইলের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন, তেল আবিব ও কিছু আঞ্চলিক শক্তির প্রস্তাব মূলত প্রতিক্রিয়া যাচাই এবং মাটিতে নতুন বাস্তবতা চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল, যার মধ্যে গাজার গ্যাসসম্পদ দখল এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গাজা রিভিয়েরা’র মতো প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা অন্তর্ভুক্ত।

যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা

গাজার ভবিষ্যৎ শাসন প্রশ্নটি আঞ্চলিক আলোচনার সবচেয়ে জটিল বিষয়গুলোর একটি, যা ইসরাইলি, মার্কিন, আরব ও ফিলিস্তিনি স্বার্থের জটিলতায় জড়িত।

বিধ্বস্ত অবকাঠামো, ভেঙে পড়া মৌলিক সেবা, এবং ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলিদের হাতে নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়া—সবই আলোচনায় যোগ করেছে।

ইসরাইলি, আরব ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের মতে, কিছু প্রস্তাবে জাতিসংঘ ও আরব লীগের সমর্থনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের কথা আছে, আবার কিছুতে সমুদ্র উপকূলের গ্যাস উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতির কথা বলা হয়েছে।

হুলিলেহ নিজেকে এখনো “ফিলিস্তিনি বৈধতার অংশ” হিসেবে উপস্থাপন করছেন এবং বলছেন, তিনি গাজাকে আলাদা সত্তা হিসেবে নেতৃত্ব দেবেন না।

তার দাবি, হামাস ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা যুদ্ধ-পরবর্তী শাসনে অংশ নেবে না, ফলে ফিলিস্তিনি কাঠামোর অধীনে ‘স্বতন্ত্র’ প্রশাসনের সুযোগ আছে।

তবে তিনি স্বীকার করেছেন, পুরো পরিকল্পনা নির্ভর করছে ওয়াশিংটন, কায়রো ও রিয়াদের ‘আশীর্বাদ’-এর উপর, এবং শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের উপর।