
রাশিয়ার একটি উপদ্বীপ শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠার পর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিপজ্জনক সুনামি। প্রাথমিকভাবে পাওয়া খবর অনুযায়ী, এ সুনামি আঘাত হেনেছে রাশিয়া ছাড়াও জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে। তবে সুনামি ছড়িয়ে পড়তে থাকায় ৫২টি দেশ ও অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এমনকি এ ভূমিকম্প এবং সুনামির জেরে বঙ্গোপসাগরেও মাত্র দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে চারটি ভূমিকম্প হয়েছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলেছে, গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে ৮.৮ মাত্রার এ ভূমিকম্পে রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপ কেঁপে ওঠে। এরপর সুনামি শুরু হয়। সূত্র : আল জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, রাশিয়ার পূর্ব কামচাটকা উপদ্বীপে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর সুনামির ঢেউ রাশিয়া, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে আঘাত হেনেছে। ভূমিকম্পটি রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের উপকূলীয় শহর পেট্রোপাভলভস্ক-কামচাটকার ১৩৬ কিলোমিটার (৮৪ মাইল) পূর্বে আঘাত হেনেছে। এরপর সুনামির প্রথম কয়েকটি ঢেউ রুশ শাসিত সেভেরো-কুরিলস্ক বন্দর এলাকায় আছড়ে পড়ে। এতে শহরটির বড় অংশ প্লাবিত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একাধিক ড্রোন ভিডিওতে দেখা গেছে, শক্তিশালী ঢেউয়ে বন্দর এলাকা প্লাবিত হয়েছে এবং চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। খবরে আরও বলা হয়, ওই এলাকায় একাধিক সুনামি ঢেউ আঘাত হানে। সেভেরো-কুরিলস্ক শহরের মেয়র আলেকজান্ডার ওভসিয়াননিকভ জানান, এর মধ্যে তৃতীয় ঢেউটি ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর, যা বন্দর অবকাঠামোর বড় ধরনের ক্ষতি করেছে।
তিনি বলেন, ‘তৃতীয় ঢেউটি সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। এতে বন্দরে থাকা আমাদের ক্ষুদ্র নৌবহর পুরোটাই সাগরে টেনে নিয়ে যায়। পানির চাপে কিছু জাহাজ উপকূলে ভেসে এসেছে, কিছু প্রণালিজুড়ে ঘুরছে।’ তবে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ভূমিকম্পের পরপরই সেভেরো-কুরিলস্ক শহরে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। এই বন্দরে সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা পাঁচ মিটার পর্যন্ত পৌঁছায়। জরিপ সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সুনামি সাধারণত সমুদ্রের নিচে হওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা ভূমিধসের ফলে সৃষ্টি হয়। যদিও সব ভূমিকম্প সুনামির জন্ম দেয় না, তবে ৭.০ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে সুনামি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আর ৮.০ মাত্রা ছাড়ালেই তা তাৎক্ষণিক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ভূমিকম্প ও সুনামি শুরু হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। এরপর জাপানের হাওয়াইতে সুনামির ঢেউ আঘাত হানে। জাপানের সংবাদমাধ্যম এনএইচকে ওয়ার্ল্ড এক প্রতিবেদনে জানায়, হোক্কাইডোতে ৩০ সেন্টিমিটার বা প্রায় ১ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। জাপানের অন্যান্য এলাকাতেও সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
জাপানের চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ইয়োশিমাসা হায়াশি জানান, তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত কিংবা ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যেও সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়ে। এখানেও তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে রাশিয়ায় ভূমিকম্প আঘাত হানার পর পরই বিভিন্ন দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। এ সুনামির আঘাত হানার সময় আজ ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় জাপানের হোক্কাইডো থেকে কিউশু পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের পুরো অংশে সতর্কতা জারি রয়েছে। একই সঙ্গে আলাস্কার দূরবর্তী আলেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কিছু অংশে, প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম দ্বীপ এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জেও সুনামি সতর্কতা জারি আছে। এ ছাড়া ফিলিপাইনের আগ্নেয়গিরি ও ভূকম্পন সংস্থাও সুনামি সতর্কতা জারি করেছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বড় ধরনের সুনামির আশঙ্কা না থাকলেও বাসিন্দাদের উপকূল এড়িয়ে চলার আহ্বান জানানো হয়। খবরে বলা হয়, তিনটি ভিন্ন মাত্রার ঢেউয়ের আশঙ্কা অনুযায়ী বিশ্বের ৫২টি দেশ ও অঞ্চল এ সতর্কতার আওতায় এসেছে। ৩ মিটারের বেশি উচ্চতার সুনামির ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি দেশ ও অঞ্চল। এগুলো হচ্ছে রাশিয়া, ইকুয়েডর এবং উত্তর-পশ্চিম হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। এক থেকে তিন মিটার ঢেউয়ের আশঙ্কায় রয়েছে ১৪টি দেশ ও অঞ্চল। এদের মধ্য রয়েছে চিলি, কোস্টারিকা, ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, গুয়াম, হাওয়াই, জাপান, জার্ভিস আইল্যান্ড, জনস্টন অ্যাটল, কিরিবাতি, মিডওয়ে আইল্যান্ড, পালমিরা আইল্যান্ড, পেরু, সামোয়া ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। শূন্য দশমিক ৩ থেকে এক মিটার উচ্চতার ঢেউয়ের সতর্কতায় রয়েছে ৩৫টি দেশ ও অঞ্চল। এসব হচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ফিজি, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি, তিউনিসিয়া, টোঙ্গা, তুভালু, ভানুয়াতু, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর, কুক আইল্যান্ডস, কেরমাডেক দ্বীপপুঞ্জ, কসরে, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, পিটকায়ার্ন, চুক, পোহ্নপেই, নাউরু, নিউ ক্যালেডোনিয়া, নিয়ুয়ে, প্যালাউ, পানামা, উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ, তাইওয়ান, হাওল্যান্ড ও বেকার দ্বীপপুঞ্জ, জন্সটন অ্যাটল, জার্ভিস আইল্যান্ড, ওয়েক আইল্যান্ড, টোকেলাও। এ ছাড়াও সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে ফিলিপাইন, চীন, হাওয়াই, ইকুয়েডর, নিউজিল্যান্ডেও।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সুনামির সম্ভাব্য ঢেউ যে কোনো সময় আছড়ে পড়তে পারে, তাই সব দেশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। সতর্ক বার্তায় আরও বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চল, সমুদ্রসৈকত ও নদীর কাছাকাছি কেও যাবেন না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য খাবার, পানি, ওষুধ ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন।’
বঙ্গোপসাগরে দেড় ঘণ্টায় চার ভূমিকম্প : বঙ্গোপসাগরে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে পরপর চারটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে ভূমিকম্পগুলো আঘাত হানে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, প্রথম ভূমিকম্পটি অনুভূত হয় মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টা নাগাদ। এর কেন্দ্র ছিল আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ২৭৫ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতলের ১০ কিলোমিটার গভীরে। সেটা ছিল ৫ মাত্রার ভূমিকম্প। এরপর কাছাকাছি এলাকায় আরও তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে। সেগুলোর মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৫, ৪ দশমিক ৯, ও ৪ দশমিক ৬। সর্বশেষ ভূমিকম্পটি ঘটে রাত সোয়া ১১টার দিকে। তবে এসব ভূমিকম্পে কোনো সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়নি। এ ছাড়া কোনো হতাহতের ঘটনাও ঘটেনি।