Image description
 

গাজায় সহায়তা নিতে গিয়ে প্রাণ হারানো ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়েছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার (UNRWA) প্রধান ফিলিপ ল্যাজারিনি বলেন, “আমাদের চোখের সামনে গাজা শিশুদের ও ক্ষুধার্ত মানুষের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। এটা এক নির্মম, পরিকল্পিত হত্যার ছক।”

শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি আরও জানান, গাজাবাসীদের এখন দুই মৃত্যুর মধ্যে বেছে নিতে হচ্ছে—ক্ষুধায় মারা যাওয়া, অথবা গুলিতে ঝরে যাওয়া।

ল্যাজারিনির এই মন্তব্য এসেছে এমন একদিনে, যেদিন গাজার মধ্যাঞ্চলীয় দেইর আল-বালাহ শহরে পুষ্টি সহায়তার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ১৫ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৯ শিশু ও ৪ নারী ছিলেন।

 

একই দিনে, গাজা জুড়ে ৪৫ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে রাফাহ শহরে একটি GHF সহায়তা কেন্দ্রে ১১ জন নিহত হন।

 

এই GHF বা Gaza Humanitarian Foundation হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত একটি বিতরণ সংস্থা, যা মে মাসে গাজার ওপর আরোপিত পূর্ণ অবরোধ কিছুটা শিথিল করার পর কার্যক্রম শুরু করে।

GHF কার্যত জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন সহায়তা নেটওয়ার্ককে একপাশে সরিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, গত মে থেকে জুলাই ৭ তারিখ পর্যন্ত ৮১৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন খাবারের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়। এর মধ্যে ৬৩৪ জন নিহত হয়েছেন GHF পরিচালিত চারটি কেন্দ্রে, আর ১৮৫ জন নিহত হয়েছেন অন্যান্য সহায়তা কেন্দ্রের আশপাশে।

ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ ও এপি জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা ও GHF-র সঙ্গে যুক্ত কিছু মার্কিন ঠিকাদার নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর কথা স্বীকার করেছেন।

জাতিসংঘে অবস্থান করা আল জাজিরার সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল এলিজন্ডো জানান, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) উপ-নির্বাহী পরিচালক কার্ল স্কাও বলেছেন, “আমি জীবনে কখনও গাজায় এত ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখিনি।”

তিনি বলেন, “আমাদের কাছে গাজার ২১ লাখ মানুষকে দুই মাস খাওয়ানোর মতো খাদ্য মজুত আছে, কিন্তু ট্রাকগুলো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।” ফলে, ফিলিস্তিনিরা বাধ্য হয়ে GHF-এর বিতরণ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে।

আল জাজিরার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ইসরায়েল গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহ শহরে একটি তথাকথিত ‘মানবিক নগরী’ গড়ে তুলতে চাইছে, যাকে অনেক বিশ্লেষক ‘ঘনবসতিপূর্ণ বন্দিশিবির’ বা ‘ঘনিষ্ঠভাবে নিয়ন্ত্রিত স্থানান্তর কেন্দ্র’ হিসেবে দেখছেন।

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে, রাফাহ শহরের বড় অংশের ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সেখানে ঘাঁটি গড়ে গাজার জনগণকে জোরপূর্বক স্থানান্তর করার ছক বাস্তবায়ন হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল লেভি বলেন, “GHF বিতরণ কেন্দ্রগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে দক্ষিণে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে ফিলিস্তিনিদের জোর করে রাফাহর দিকে ঠেলে দেওয়া যায়।” তার ভাষায়, “আমরা গাজায় দ্বিতীয় নাকবা প্রত্যক্ষ করছি।”


শুক্রবার রাতে নিহতদের মধ্যে ৮ জন ছিলেন জাবালিয়ার একটি স্কুলে, যেখানে গৃহহীনরা আশ্রয় নিয়েছিল। ইসরায়েলি বাহিনী রাতের আঁধারে হামলা চালায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, “আমি এমন দৃশ্য দেখেছি যা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। এক শিশুর মাথা ছিল না—একেবারে বিচ্ছিন্ন।”

অন্যদিকে, গাজা শহরের তুফাহ এলাকায় এক বাড়িতে হামলায় এক শিশু নিহত হয়েছে বলে আল-আহলি আরব হাসপাতাল নিশ্চিত করেছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “হাসপাতালগুলো প্রতিদিনই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। জ্বালানির অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবা, যেমন ডায়ালাইসিস, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।” এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে পশুবাহিত গাড়িতে রোগী পরিবহন করতে হচ্ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্তেফান দুজারিক বলেন, “ইসরায়েল যেভাবে মানবিক সহায়তা আটকাচ্ছে, তা সরাসরি জীবন হুমকির মুখে ফেলছে।” তার ভাষায়, “প্রতিদিন যুদ্ধবিরতি না থাকার মানে হলো—আরও অনর্থক মৃত্যু, ব্যথায় কাতর শিশুর মৃত্যু, এবং অনাহারে মানুষ গুলি খেয়ে মারা যাওয়া।”