Image description

ফরাসি ইতিহাসবিদ জ্যাঁ-পিয়ের ফেলিউ যখন গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করেন, তখন প্রথমেই তিনি বুঝতে পারেন, এই গাজা তিনি চেনেন না। আগের বহুবার ভ্রমণের পরিচিত ল্যান্ডমার্ক, রাস্তা, ভবন, শহর- সব কিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তিনি দিক হারিয়ে ফেলেন। তিনি লিখেছেন- ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে কনভয় সামনে এগোয়। প্রতিটি মুহূর্ত যেন একেকটি বিভীষিকার দৃশ্য। একটি গাছ পড়ে আছে, ডালপালা মুচড়ানো। একটি ধ্বংস হওয়া ঘর। দূরে একটি ভবন ভেঙে পড়ছে। গাড়ি যতটা সম্ভব চলাচল করে বিধ্বস্ত রাস্তাগুলোর উপর দিয়ে। আমি নিশ্চিতভাবে জানি- যে গাজা আমি চিনতাম, সেটি আর নেই। এ যেন এক শূন্য মরুভূমি। অথচ হাজার বছরের ইতিহাসে গাজা ছিল একটি সবুজ অভয়ারণ্য।

জ্যাঁ-পিয়ের ফেলিউ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস নিয়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান গবেষক। বর্তমানে একমাত্র ইউরোপীয় একাডেমিক হিসেবে তিনি গাজার ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। প্যারিস থেকে ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রতিযোগী থাকলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু গাজার ইতিহাস লেখা কঠিন। কারণ কোনও আর্কাইভ নেই। একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাই আমার ফিরতে হয়েছে। দূর থেকে তথ্য জোগাড় করছিলাম। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসরাইলের অনুমোদন নিয়ে তিনি আম্মানে যান। তারপর কারেম শালোম সীমান্ত দিয়ে ফরাসি চিকিৎসকদের একটি দলের সঙ্গে গাজায় প্রবেশ করেন। সেখানে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাদের অভ্যর্থনা জানান। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কিছু ওষুধ ও সর্বোচ্চ ৩ কেজি খাবার সঙ্গে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এক মাস তিনি সেখানে কাটান। তিনি লিখেছেন ‘আন হিস্তোরিয়েন আ গাজা’ (গাজার এক ইতিহাসবিদ)। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইংরেজিতে অনুবাদ প্রকাশ হয় বইটির। এই বইতে এবং তার সাক্ষাৎকারগুলোতে স্পষ্ট- তিনি একদিকে ভয়াবহতা তুলে ধরতে চান, আবার অন্যদিকে নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদের মতো পেশাগত সতর্কতা বজায় রাখতে চান।

ফেলিউ বলেন, আমি ইউক্রেন, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, সোমালিয়া- যুদ্ধবিধ্বস্ত অনেক দেশ দেখেছি। কিন্তু এমন কিছু কখনও দেখিনি। এখন বুঝি, কেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে এখানে (গাজা) ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরাইল।

তিনি লিখেছেন- গাজায় একটানা গর্জনে মাথা ফাটার উপক্রম। ড্রোনের শব্দ এত তীব্র যে বাইরে সাধারণভাবে কথা বলা অসম্ভব। ড্রোন, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ব্যক্তিগত অস্ত্র- সব কিছুর আওয়াজের পার্থক্য বুঝে উঠতে শেখেন তিনি। মৃত্যু এখানে কোনো নিয়ম মানে না। হঠাৎ যেকোনো সিদ্ধান্ত- কোথায় দাঁড়াবেন, কখন ঘুমাবেন- সেটিই ঠিক করে দেয় আপনি বেঁচে থাকবেন, না মারা যাবেন। কেউ মারা গেলে দাফনের সুযোগ নেই। কবর নেই। অনেকে মৃতদের নাম বাড়ির ধ্বংসাবশেষে লিখে রাখেন। শিশুর নামের পাশে ছোট্ট আঁকাবাঁকা চিহ্ন যুক্ত করেন।

তিনি আরও লিখেছেন, একসময় গাজার স্কুলশিশুদের ইউনিফর্ম ছিল, বই ছিল। এখন তারা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, খালি হাতে। ময়লা স্তূপে খুঁজে বেড়ায় কাগজ, পলিথিন, যা দিয়ে একটু আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা পাবে। একটি শিশুকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, এত অল্প খাবার নিয়েও কেন তারা রাস্তায় থাকা ক্ষুধার্ত বিড়ালদের খাওয়াচ্ছে। উত্তরে শিশুটি বলে, আমরা জানি ক্ষুধা কেমন। তাই চাই না ওরাও সেই কষ্ট পাক।

গাজায় বর্তমানে মাত্র ৪ জন মনোরোগ চিকিৎসক আছেন। ইউনিসেফ জানায়, লাখ লাখ শিশু মানসিক ও সামাজিক সহায়তার জন্য হাহাকার করছে। গাজায় আগে যে আত্মীয়তা ও পারিবারিক বন্ধন ছিল, তাও এখন ক্ষুধার চাপে ভেঙে পড়েছে। ফেলিউ বলেন, প্রত্যেকে এখন শুধু নিজেদের ক্ষুধার্ত পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। গাজার এতিমদের ট্র্যাজেডি সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। অনেক শিশু হাসপাতালে পড়ে থাকে। তাদের আত্মীয়-স্বজন নেই। কেউ তাদের দেখতেও আসে না। বহু জায়গায় তিনি দেখেন মেডিক্যাল ক্লাউনরা শিশুদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে চেষ্টা করছে, যা এই বিভীষিকার মধ্যে একটা আশার আলো।

তিনি আরও লিখেছেন, একজন বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি তার তাঁবুর সামনের ময়লা ফেলে জায়গা পরিষ্কার রাখছিলেন। একটি পরিবার বিধ্বস্ত একটি ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। কাপড় শুকাচ্ছে টিনের বারান্দায়। ছাউনি ছায়া ফেলেছে ধূসর ধ্বংসাবশেষে- সবুজ, নীল আর লাল রঙের। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮০ শতাংশ বন্ধ। কেউ কেউ ব্যাংক অ্যাপ কিংবা নগদ অর্থে (ইসরাইলি শেকেল) লেনদেন করে।
ফেলিউ এক জায়গায় হিসাব দেন- প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩৩ হাজার মানুষ বাস করছেন সেখানে। দুই পাশে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার তাঁবু। কেউ কেউ সমুদ্রতীরে ঘর বানিয়ে নিয়েছে।

শীতের দিনে পানির অভাব ভয়ংকর। প্রতিদিন মাথাপিছু ৯ লিটার পানি মেলে। এর এক-চতুর্থাংশও খাওয়ার উপযোগী না। আগে এই হার ছিল ৮০ লিটার। অসুস্থতা, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, নারীদের জন্য ত্বক ও অন্ত্রের রোগ- সবকিছু যেন নিয়তি হয়ে গেছে। শৌচাগার বলতে বালিতে খুঁড়ে রাখা গর্ত, উপরে পর্দা হিসেবে একটি ছেঁড়া কাপড়। এটাই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ‘ভান’।

শিশু সিলা মাত্র তিন সপ্তাহ বয়সে ঠাণ্ডায় মারা যায়। এক বৃদ্ধা বলেন- কখনও এত ঠাণ্ডা পাইনি। কখনও এত ক্ষুধার্ত হইনি। জ্যাঁ-পিয়ের ফেলিউ প্যারিসের ‘সায়েন্স প’-তে ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনি মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বহু বছর ধরে কলাম লেখেন ‘লা মান্ডে’তে। তিনি ‘গাজা: এ হিস্টরি’ এবং নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবনীসহ বহু গ্রন্থের লেখক। তার মতে, গাজা নিয়ে আজও একাডেমিক দৃষ্টিকোণে অন্ধত্ব বিরাজ করছে। তিনি বিশ্বাস করেন, ইসরাইল গাজার সমাজকে জানে না। ড্রোন বা ট্যাঙ্ক থেকে দূরে বসে সমাজ বোঝা যায় না। 

একসময় গাজায় বিরাট সাংস্কৃতিক পরিসর ছিল- র‌্যাপ ব্যান্ড, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সব ছিল। তারা হামাসের বিরোধিতায়ও সোচ্চার ছিল। কিন্তু এখন সব ধ্বংস। হামাসবিরোধী বিক্ষোভের সময় ইসরাইল বোমাবর্ষণ করছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো- ইসরাইল এখন ‘আবু শাবাব’ নামের অপরাধী গ্যাংকে সমর্থন দিচ্ছে। তারা ত্রাণবাহী ট্রাক লুট করে। ফেলিউ স্বচক্ষে দেখেছেন- রাত ২:৩০-এ এই গ্যাং ও নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেখানে ১১ জন নিহত ও ৫০টি ট্রাক লুট হয়। এই গ্যাংদের সহায়তায় ‘ইসরাইল নিজেই হামাসকে শক্তিশালী করছে’। কারণ সাধারণ মানুষ লুণ্ঠনকারীদের ঘৃণা করে। আর যখন হামাস লুণ্ঠনকারীদের শাস্তি দেয়, তখন জনগণ সেটাকে সমর্থন করে। তিনি বলেন, এরা এমন অপরাধী যাদের পরিবারও তাদের ত্যাগ করেছে। এদের উপর নির্ভর করে গাজা নিয়ন্ত্রণ করা- নৈতিকতা বাদ দিন, কৌশলগতভাবেও ভয়ঙ্কর।

ফেলিউ বলেন, গাজা শুধু একটি অঞ্চল নয়, এটি ভবিষ্যতের পরীক্ষা কেন্দ্র। এখানে আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার, জেনেভা কনভেনশন- সবকিছু ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব সীমানার বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। এটি গোটা বিশ্বের জন্য হুমকি। ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলাও সম্প্রতি বলেন- আজ গাজার শিশুরা মরছে। কাল আমাদের সন্তানদের পালা আসবে। 

জ্যাঁ-পিয়ের ফেলিউর মতে, গাজা এখন এক ‘হতাশার ভূগোল’। এমনকি নির্দেশ মেনে অন্যত্র চলে গেলেও সেখানে নিরাপত্তা নেই। তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন ওয়ালা ফ্রাঙ্গি ও আহমাদ সালামের মৃত্যুতে। এই দম্পতি গাজা শহর ছেড়ে নুসেইরাত ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। ২৫ ডিসেম্বর তারা সেখানেই বোমায় নিহত হন। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তারা ৪৫,৩৩৯ ও ৪৫,৩৪০ নম্বর মৃত।