
সম্প্রতি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠন জামাআত নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (জেএনআইএম)। তারা নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে জনপদ। চাপিয়ে দিচ্ছে নিজেদের শরিয়া আইন। আর আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠছে প্রতিদিন। যাদের বর্বরতা গোটা আফ্রিকাকে করে তুলেছে টালমাটাল ও রক্তাক্ত।
সোমবার বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-কায়েদার সহযোগী জঙ্গি গোষ্ঠী জেএনআইএম বর্তমানে পশ্চিম আফ্রিকার অন্যতম প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। গত ১ জুলাই সংগঠনটি মালির পশ্চিমাঞ্চলে সেনেগাল ও মৌরিতানিয়া সীমান্তের কাছে অবস্থিত সাতটি সামরিক ঘাঁটিতে সমন্বিত হামলার দায় স্বীকার করেছে। এই ঘটনা অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিগত পাঁচ বছরে জঙ্গি হুমকি সামাল দিতে ব্যর্থতা এবং ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ঠেকাতে না পারার কারণে বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজারে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারগুলোও তাদের পূর্বসূরি সরকারগুলোর মতোই জেএনআইএমের হুমকি প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এই পরিস্থিতি পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জেএনআইএম কী
জেএনআইএম হলো আফ্রিকার অন্যতম ভয়ঙ্কর ও সক্রিয় সন্ত্রাসী সংগঠন। যেটি অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই মারাত্মক সন্ত্রাসী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালে মালিতে পাঁচটি জঙ্গিগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে এই জোটটি গঠন করে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন, মালির সাবেক কূটনীতিক ইয়াদ আগ ঘালি।
জঙ্গিবাদের লক্ষ্য
জামাআত নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল-মুসলিমিন (জেএনআইএম) সাহেল অঞ্চলের সরকারগুলোর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। তারা তাদের নিজস্ব কঠোর শরিয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নারীদের একা চলাচল নিষিদ্ধ, পুরুষদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক, সংগীত ও ধূমপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যদিও তাদের জোরপূর্বক এই বিধিনিষেধগুলো ইসলামিক সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দুর্বল সরকার, ন্যায়বিচারের অভাব ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা জেএনআইএম-এর বিকল্প শাসনব্যবস্থাকে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলছে।
জেএনআইএমের অবস্থান ও বিস্তার
জেএনআইএম প্রথমে মালির মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে বেশি সক্রিয় ছিল। তবে দ্রুতই সংগঠনটি তার কার্যক্রম বিস্তৃত করে। বর্তমানে এর প্রধান ঘাঁটি বুরকিনা ফাসো, মালি এবং নাইজারে হলেও এটি বেনিন, টোগো এবং আইভরি কোস্টেও হামলা চালিয়েছে। ট্রান্সন্যাশনাল সংঘবদ্ধ অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থা গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অ্যাগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম জানিয়েছে, জেএনআইএম এখন পুরো মালিজুড়ে এবং বুরকিনা ফাসোর ১৩টি অঞ্চলের মধ্যে ১১টিতেই সক্রিয় আছে।
ব্যাপকহারে বাড়ছে হামলার মাত্রা
বিবিসি মনিটরিং-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বুরকিনা ফাসোতে জেএনআইএম ২৮০টির বেশি হামলা চালিয়েছে। এই সংখ্যা ২০২৪ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। সংগঠনটি দাবি করেছে, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তারা সাহেল অঞ্চলে প্রায় ১০০০ মানুষকে হত্যা করেছে। যাদের অধিকাংশই ছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বা সরকারপন্থি মিলিশিয়া। এর মধ্যে ৮০০ জন নিহত হয়েছেন বুরকিনা ফাসোতে। মালি ও বেনিনেও শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
অবৈধ আয়ের উৎস
জেএনআইএম বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এক সময় তারা বিদেশি নাগরিকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করলেও এখন পশু চুরি তাদের প্রধান আয়ের উৎস। মালির একটি জেলায় এক বছরে গবাদিপশু বিক্রি করে তারা প্রায় ৭.৭ লাখ ডলার আয় করেছে। এছাড়া তারা স্বর্ণ খনি, পণ্য পরিবহণ ও চোরাচালানের ওপর কর আরোপ করে এবং জনগণের কাছ থেকে ‘সুরক্ষা’ প্রদানের নামে জোরপূর্বক কর আদায় করে।
জেএনআইএমবিরোধী লড়াই
জেএনআইএম-এর উত্থান ঠেকাতে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা প্রচেষ্টা চালালেও তা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সফল হয়নি। মালি সরকারকে সহায়তা করতে প্রায় এক দশক ধরে ফ্রান্স সাহেল অঞ্চলে ৪,০০০ সেনা মোতায়েন করে। ২০১৪ সালে সাহেল দেশগুলো জি-৫ সাহেল টাস্কফোর্স গঠন করে। কিন্তু সম্প্রতি বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজার সেখান থেকে সরে যাওয়ায় সেই জোট দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মালি, বুরকিনা ফাসো ও নাইজারে একরে পর এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। বিশ্লেষকদের ধারণা, এই সরকারগুলোর দুর্বল প্রশাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন জেএনআইএম-এর মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বিকাশে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।