
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইরান ক্রমশ নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিল যে, তারা শিগগিরই ইসরাইলকে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে। তেহরানের ফিলিস্তিন স্কয়ারে ‘ইসরাইলে ধ্বংস’ ঘড়িটি কেবল সাহসিকতার অনুশীলন ছিল না। এটি ছিলো আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিদের একটি প্রকাশ্য ‘কাউন্টডাউন’, যা তাদের হাতে ইসরাইলের আসন্ন পতনের ক্ষণ গণনা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে আক্রমণ করার আগে হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার তাদের সাথে পরামর্শ এবং সমন্বয় করতে ব্যর্থ হওয়ার হতাশার পাশাপাশি, ইরানের শাসকগোষ্ঠী সেই হামলার সাফল্য, ইসরাইলের দুর্বলতার স্পষ্ট প্রমাণ এবং এর ফলে সৃষ্ট চলমান অস্থিরতা থেকে উৎসাহ পেয়েছিল।
সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ইসরাইলের রাজনৈতিক নেতাদের সামরিক ও নিরাপত্তা প্রধানরা বিচক্ষণতার সাথে বলেছিলেন যে, ইসরাইলকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে। বিশেষ করে জুন মাসে এবং অবশ্যই এর খুব বেশি পরে নয়। ২০২৫ সালের শেষ অনেক দেরি হয়ে যাবে। তারা পরামর্শ দিয়েছিলেন, হামলা এখনই করতে হবে, নয়তো কখনই নয়। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে কয়েক সপ্তাহ দূরে ছিল। তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ইসরাইলের জন্য একটি অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে উঠছিলো।
ইসরাইলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের কথা শুনেছিলো। এ বিষয়ে তারা মার্কিন প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করেছিল। এরপরই ইসরাইল ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় এবং নিজেকে রক্ষা করে।
জেরুজালেমে যাওয়ার পথে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ভ্যালিয়াসর স্কয়ারে, একটি বিশাল ব্যানার টাঙানো হয়েছিলো। যেখানে মুসলিম জনতাকে দেখানো হয়েছিলো তাদের দেশের পতাকার নিচে, ফিলিস্তিন, বিদ্রোহ-পূর্ব সিরিয়া এবং ইরান সমর্থিত ইসলামিক গোষ্ঠীগুলো জেরুজালেমের আল-আকসা চত্বর দিয়ে ডোম অফ দ্য রকের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। এটি ছিলো ইহুদিবাদী ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ থেকে জেরুজালেমের মুক্তির প্রতিনিধিত্ব, যা দৃশ্যত এখন আসন্ন, হামাসের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে আক্রমণের পরে।
৭ অক্টোবরের ঘটনার পর, ইরানের সরকার তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ত্বরান্বিত, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের গতি বাড়ানো এবং তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো সরাসরি ইসরাইলে আক্রমণ করে এবং অক্টোবরে আরেকটি বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
ইসরাইল প্রকাশ্যে এই আক্রমণের ক্ষমতা নিয়ে উপহাস করলেও, তারা ব্যক্তিগতভাবে ইরানের সাহস এবং তার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর দ্বারা সৃষ্ট বিপদগুলোকে স্বীকৃতি দেয়। তবে, ২০২৪ সালের শেষের দিকে, ইরান তার গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীদের হারাচ্ছিল। ইসরাইল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিজবুল্লাহর শেখ হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছিলো।
হামাস তখনো গাজায় ইসরাইলিদের জিম্মি করে রেখেছিলো এবং ইসরাইল তাদের সম্পূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক শাসন ক্ষমতা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। এরপর সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটে। দ্রুত ইসরাইলি সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে নতুন বিদ্রোহী সরকার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পদ কব্জা করতে পারেনি। সেখানে আকাশসীমায় ইসরাইলেরআধিপত্য নিশ্চিত করা হয়।
তেহরানের শাসকগোষ্ঠী পরমাণু বোমা তৈরির প্রচেষ্টা আরো ত্বরান্বিত করে। তারা ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ বাড়িয়েছে। অস্ত্রায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। যা স্পষ্ট করে তুলেছিলো যে, তারা বোমা তৈরির কতটা কাছাকাছি। সেই সঙ্গে ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। ইসরাইল বলছে, ইরান প্রায় দুই হাজার ৫০০টি অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের একটি ভাণ্ডার তৈরি করেছে। যার মধ্যে অনেকগুলো এক টন ওয়ারহেড ধারণ করতে সক্ষম। ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে চার হাজার এবং ২০২৭ সালের মধ্যে আট হাজার তৈরি করার পথে রয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠছিলো।
হিজবুল্লাহর ওপর ব্যাপক আঘাত হানার পরেও, যার উপর নির্ভর করে তারা ইসরাইলে প্রতিদিন এক হাজার থেকে তিন হাজার রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতো। ইরান আত্মবিশ্বাসী ছিল যে ইসরাইলের ওপর তাদের স্থল আক্রমণ পরিকল্পনা কার্যকর থাকবে। যার ফলে জর্ডানসহ প্রায় প্রতিটি ফ্রন্টে হামাসের আক্রমণের প্রতিফলন ঘটতে পারে। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি বলেছেন, ইরান ধারণা করেছিলো যে বহুমুখী আক্রমণের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘ পরিকল্পিত ‘ইসরাইলের ধ্বংস’ প্রকল্পটি কার্যকর হবে। যা একটি ধ্বংসাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার মধ্যে পরিচালিত হয়েছিল।
তবে ইরানের লক্ষ্য অর্জনের মূল বিষয় ছিল প্রথমে আক্রমণ করা এবং ইসরাইলকে অবাক করে দেওয়া।
ইরানের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি
ইসরাইলের সামরিক ও নিরাপত্তা পরিকল্পনাকারীরা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক মহল থেকে প্রতিরোধের জন্য সবুজ সংকেত পেয়েছিলেন।
ইসরাইল বছরের পর বছর ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে বোমা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয়তাকে ধারাবাহিকভাবে অগ্রাধিকার দেয়নি বা প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করেনি। বিশেষ করে ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসন ইরানের সাথে জেসিপিওএ চুক্তিতে পৌঁছানোর পর।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরাইলি হামলার ফলে তেহরান কীভাবে জবাব দিতে পারে তার একটি অভূতপূর্ব মহড়া পরিচালনা করেছিল তেলআবিব। তবে ইসরাইল ২০২৪ সালের অক্টোবরে এমন একটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিলো, যা কেবল পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুতেই নয়, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও হামলার আওতায় থাকবে।
গত এপ্রিল মাসে ইসরাইলের যুদ্ধ পরিকল্পনাকারীরা জুন মাসকে আক্রমণের জন্য আদর্শ সময় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তারা মূল্যায়ন করেছিলেন যে, ইরান সম্পর্কে ইসরাইলের গোয়েন্দা তথ্য সম্ভবত এর পরে কমতে শুরু করবে। বিশেষ করে পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষেত্রে। কারণ পরমাণু অস্ত্র তৈরি চূড়ান্ত পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত স্থাপনায় বাকি কাজ সম্পন্ন হতে পারে।
ঘটনাক্রমে নয়, ট্রাম্প ইরানকে কূটনীতির জন্য ৬০ দিনের সময় দিয়েছিলেন। ১২ জুন তা শেষ হয়ে যায়। সামরিক পরিকল্পনাকারীরা মূল্যায়ন করেছিলেন যে, ইরানিরা তাদের নিজস্ব আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ইসরাইলের আগাম আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই ইসরাইলের প্রথমদিকের হামলাগুলো ধ্বংসাত্মক ছিলো।
পরকল্পনা নেওয়া হয়, প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, ইরানের প্রধান কমান্ডারদের অপসারণ করতে হবে। একইভাবে, ইরানি সামরিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করতে হবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে তার সংখ্যা কমানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করার প্রস্তুতি নেয় ইসরাইল।
ইসরাইল সিদ্ধান্ত নেয় সক্ষমতার পূর্ণ মাত্রায় ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার। সেইসাথে, যেসব বিজ্ঞানী পরমাণু বোমা তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাদেরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়।
ইরানকে অবাক করে দেওয়া জরুরি ছিলো। তেহরানের আকাশপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করাও একইভাবে জরুরি ছিল। যাতে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে ক্রমাগত আক্রমণ চালানো সম্ভব হয়। তবে যখন আক্রমণ চালানোর জন্য এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার পথ পারি দিতে হচ্ছে, তখন কীভাবে চূড়ান্ত অবাক করা সম্ভব?
হামলা চালানোর আগে অনেক উচ্চপদস্থ সেনা ও নিরাপত্তা কর্মীকেও এ সম্পর্কে জানানো হয়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠরাই সম্পূর্ণভাবে জানতেন।
বিমান বাহিনী কীভাবে তার ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার ফ্লাইটকে টেলিস্কোপিকভাবে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো যে ইরান জানতই না যে হামলা হচ্ছে। হামলার আকস্মিকতায় ইরান হতাশ হয়ে পড়েছিলো।
১৩ জুন ভোরে আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মোবাইল ফোনে অ্যালার্মের শব্দে পুরো ইসরাইল জেগে ওঠে এবং হোম ফ্রন্ট কমান্ডের মুখপাত্ররা জাতীয় টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে দেশকে জানান যে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। যার মধ্যে একটি সম্ভাবনা হলো ইরান থেকে আক্রমণ।
আইডিএফ অনুমান করেছিলো যে, ইসরাইলি আক্রমণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান ৩০০-৫০০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের চেষ্টা করবে। প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যে এটি তিনশত পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে। সেই কারণেই পুরো দেশকে সতর্ক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
ইসরাইলের হামলার পর প্রথম ১৮ ঘণ্টার মধ্যে ইরান কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে সক্ষম হয়নি। তারা জানতো ইসরাইল হামলা করবে কিন্তু কখন করবে তা জানতো না। ইসরাইল ভোর ৩টার ঠিক আগে আক্রমণ করে, ইরান রাত ৯টার কিছু পরেই তাদের প্রথম দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের মহাকাশ প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহকে ইসরাইলি নিরাপত্তা প্রধানরা ইরানের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। হামলার প্রাথমিক তালিকায় ছিলেন তিনি। হামলার শুরুর দিকে হাজিজাদেহ একটি সামরিক বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই তাকে এবং আইআরজিসি বিমান বাহিনীর আরো পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরাইল।
অবিশ্বাস্য সাফল্য
ইসরাইলের সামরিক পরিকল্পনাকারী এবং অপারেশনাল প্রধানরা প্রাথমিকভাবে আক্রমণটিকে একটি অবিশ্বাস্য সাফল্য বলে মনে করেন। আইডিএফ চিফ অফ স্টাফ ইয়াল জামির বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং এর ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ‘উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। পূর্বনির্ধারিত প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করা হয়েছিলো। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইরানের শত শত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা হয়েছিলো।
ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন। তাদের স্থান পূরণ করা সহজ নয়। নাতাঞ্জ, ইস্পাহান এবং ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ধারণা করা হয় যে, ইরানের কাছে এখনো প্রায় সাতশত থেকে এক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র এবং দুইশত লঞ্চার রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আইডিএফ ইরানের সমগ্র সামরিক উৎপাদন ব্যবস্থার অসংখ্য উপাদানকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ইরান ইসরাইলে এক হাজার ড্রোন ছুঁড়েছিল। যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের মাত্র ১৪ শতাংশ আঘাত হেনেছে
তবে অহংকারের কোনো অবকাশ নেই। ১২ দিনের যুদ্ধে বিস্ময়কর সাফল্য ইসরাইলের জন্য একটি অস্থায়ী অর্জন।
ইরান থেমে নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আয়াতুল্লাহ তার অনুসারীরা ক্ষমতা ধরে রাখবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরাইলকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চলমান থাকবে। শনিবার রাতে এক সাক্ষাৎকারে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছিলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে তারা এখন পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় চালু করবে।’ তবে তাদের তা থেকে বিরত রাখা হবে। এটি অস্তিত্বের সংগ্রামের শেষ নয়। কারণ ইরানের শাসকগোষ্ঠী এখনও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের নেতা আলি খামেনি তার বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা করেছেন, ইরান কখনো আত্মসমর্পণ করবে না, বরং তারা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে।
কিন্তু তা হয়নি। ইসরাইল তেহরানের ওপর আকাশপথে আধিপত্য বজায় রেখেছিলো। ৩০ বছর আগে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর থেকে তেহরানের ওপর কোনো আক্রমণ চালানো হয়নি। ইরানের শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতার কোথাও না কোথাও হয়তো এই ধারণা ছিল যে, ইসরাইল তা করতে পারে এবং তা করার সাহস করবে।
কিন্তু ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের মাত্র ১৪ শতাংশ জনবহুল এলাকা এবং কৌশলগত অবকাঠামোতে আঘাত হানে। যেখানে প্রতিরক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
ইরানের হামলায় ২৮ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই বেসামরিক নাগরিক। ৩ হাজারেরও বেশি লোককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ২৩ জন গুরুতর আহত হন। অনেক বাড়িঘর ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৩ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। বেয়ারশেবার সোরোকা হাসপাতাল এবং শহরের একটি ডে কেয়ার সেন্টার, রেহোভোটের ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা ভবন, হাইফার তেল শোধনাগার, বেনি ব্রাকের প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসন কেন্দ্র, সবকিছুই ইরানের হামলার শিকার হয়।
ইরানি শাসকগোষ্ঠী তাদের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা এড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
কখন থামতে হবে তা জানা
সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুদ্ধের জন্য অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য আগে থেকেই একমত হয়েছিলো। ১২ দিন পরে আইডিএফ জানায়, তাদের লক্ষ্য অর্জন করা হয়েছে এবং যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে ইসরাইলের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ইরান শক্তিশালী হবে।
আইডিএফ অনুমান করেছিলো যে, যুদ্ধ ৩০ দিন স্থায়ী হলে হোম ফ্রন্টে ৪০০ জন নিহত হবে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছিলো।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একমত হন যে, ক্ষয়ক্ষতির যুদ্ধ এড়াতে হবে এবং ইরানকে সংঘাতের ভারসাম্য পরিবর্তনের জন্য সময় দেওয়া উচিত নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটে।
গাজার বিপরীতে, যেখানে হামাসের হুমকি দূর করা এবং সমস্ত জিম্মিদের ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার কারণে যুদ্ধ চলছে, তবে ইরানে নির্দিষ্ট কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
ইসরাইল ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায়। যদি আইডিএফকে আবার আক্রমণ করতে হয়, তবে তারা বিশ্বাস করে যে তারা কয়েক দিনের মধ্যেই তা করতে পারবে।
আত্মসমর্পণ নয়
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ভ্যালিয়াসর স্কয়ারে একটি নতুন চিত্রকর্ম স্থাপন করা হয়েছে। জেরুজালেমের দিকে পদযাত্রার পিছন থেকে চিত্রিত দৃশ্যের পরিবর্তে, এই স্থাপনায় অন্য আরেকটি চিত্র টাঙাগানো হয়েছে।
এটি আত্মসমর্পণের কোনো প্রতিকৃতি নয়। চিত্রিত ইরানি, বেসামরিক এবং সামরিক সদস্যরা অভিবাদন জানাচ্ছেন। রকেটগুলো তাদের পিছনে ধোঁয়ার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। এর সাথে থাকা স্লোগানটি ঘোষণা করছে, ‘আমরা সবাই ইরানের সৈনিক।’
কিন্তু এবার কেবল ইরানি পতাকা দেখানো হয়েছে। আর এর পটভূমিতে জেরুজালেমের ডোম অব দ্য রক নয় বরং ইরানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, মাউন্ট দামাভান্দ। এর মধ্যে ইরান জাতীয় ঐক্যের বার্তা এবং সম্ভবত অভ্যন্তরীণ মনোযোগের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এটা সম্ভব যে ইরান তার ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কিছু এমনকি বেশিরভাগই হয়তো স্থানান্তর করেছে। ইরান ইসরাইলের চেয়ে প্রায় ৭৫ গুণ বড়। এটা অসম্ভব নয় যে পাকিস্তান বা উত্তর কোরিয়া ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ করার চেষ্টা করতে প্রলুব্ধ হতে পারে।
যতদিন ইরান সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে, ততদিন নবীন, সম্ভবত আরো উগ্রপন্থী নেতারা পুরনোদের স্থলাভিষিক্ত হবেন। ১২ দিনের যুদ্ধ শেষে ইরান হয়তো আগের চেয়েও বেশি উৎসাহিত হয়ে বোমা তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
শনিবার,আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ইরান ‘কয়েক মাসের মধ্যে’ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুনরায় শুরু করতে পারে।
‘যদি আমরা এখনই ব্যবস্থা না নিতাম...’
ইসরাইল অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। তাছাড়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার কেবল নিজেকে বাঁচানোর অবস্থানে ছিলো। কারণ তথ্য ফাঁসের ভয়ে তিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইরান এবং তার অন্যান্য সহযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় না করার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ গত সপ্তাহে দাবি করেছেন যে, বিমান বাহিনী তেহরানের ফিলিস্তিন স্কয়ারে ‘ইসরাইলের ধ্বংস’ ঘড়িতে আঘাত করেছে। যা ২০৪০ সালে ইসরাইলের ধ্বংসের পূর্বাভাসের ক্ষণ গণনা করছে। এটা স্পষ্ট নয় যে ঘড়িটি ভেঙেছে কিনা। যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে ইরান নিঃসন্দেহে এটি মেরামত করবে। ইসরাইল ভালো করেই জানে, ২০৪০ সালের অনেক আগেই ইসরেইলকে ধ্বংসের লক্ষ্য ছিলো ইরানের।
মঙ্গলবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধকে ‘ঐতিহাসিক’ বিজয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এটি সম্ভাব্য নতুন চুক্তির দরজা খুলে দেবে। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেছেন যে, এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকবে। তিনি দাবি করেন, ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আরো ঘোষণা করেছেন যে, ‘যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ না নিতাম, তবে নিকট ভবিষ্যতে ইসরাইল ধ্বংসের মুখোমুখি হত। এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।’
শীর্ষনিউজ