
চলতি মাসে ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির এ হামলায়ে ইরানের মূল সামরিক অবস্থান এবং নেতাদের নিশানা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ইসরায়েলের এ আক্রমণের পেছনে বছরের পর বছর ধরে পরিচালিত গোয়েন্দা কার্যক্রমের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এর পেছনে কেবল ইসরায়েলি গুপ্তচর নয়, আরও নানা উপায়ে ইরানকে ঘায়েল করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) আলজাজিরার এক বিশ্লেষণে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অবকাঠামো ধ্বংস এবং সামরিক কমান্ডারদের হত্যার জন্য ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংস্থাটির গুপ্তচররা ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এমনকি এ হামলার পর ইরানে বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মোসাদের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি, ইসরায়েলের পক্ষে সংবাদমাধ্যমে সমর্থন প্রদান বা জনমত ব্যাহত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সম্প্রতি ইরান সরকার তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং নিরাপত্তা দলকে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসরায়েলি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সংবেদনশীল যোগাযোগ যাতে ফাঁস না হয় সেজন্য এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইরানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জনগণের কাছে গত কয়েক বছরে কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেওয়া ভবনের তথ্য জানানোর অনুরোধ জানিয়েছে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের এই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশটিতে সাম্প্রতিক আক্রমণের জন্য এসব কার্যক্রমকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানে এই অনুপ্রবেশ কতটা বিস্তৃত এবং কতদিন ধরে চলছে?
ইসরায়েলের প্রাথমিক আক্রমণে গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা কতটা?
ইরানের উপর ইসরায়েলের আক্রমণের পরপরই এর পেছনে থাকা গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বতন সদস্যদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ সব হামলার বিস্তারিত জানানো হয়েছে। এসব হামলায় মানব গোয়েন্দা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এটি ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
১৭ জুন, আক্রমণের মাত্র কয়েকদিন পর, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এই আক্রমণ সম্পর্কে জানা ১০ জন ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। মোসাদের সাবেক গবেষণা পরিচালক সিমা শাইন এপিকে বলেন, এই আক্রমণটি ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে লক্ষ্য করে মোসাদের বছরের পর বছর ধরে পরিচালিত কাজের চূড়ান্ত ফল।
এই প্রতিবেদনে ইসরায়েলি এজেন্টরা কীভাবে ইরানে ড্রোন এবং মিসাইল সিস্টেম স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল তা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলি এজেন্টদের দেওয়া তথ্য এবং পূর্ববর্তী আক্রমণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি এআই মডেল দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যবহৃত হয়।
ইসরায়েলের দাবি, ইরানের কুদস ফোর্সের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাইদ ইজাদি এবং বেহনাম শাহরিয়ারি গত সপ্তাহে নিহত হয়েছেন। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক দ্বারা তাদের অবস্থান নির্ধারিত হয়েছিল।
এর আগে গত ১৭ জুন ইসরায়েল ইরানের অন্যতম ঊর্ধ্বতন সামরিক ব্যক্তিত্ব মেজর জেনারেল আলী শাদেমানিকে হত্যা করে ইসরায়েল। নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলার মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়।
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ মিরি আইসিন যুক্তরাজ্যের দ্য অবজার্ভারকে বলেন, ইসরায়েলের গোয়েদের সক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের খুব কমই ধারণা রয়েছে। কেউ যদি নজরদারি এড়াতে চান তাহলে তাকে সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বা ইলেক্ট্রিক ডিভাইস থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের এসব থেকে বিচ্ছিন্ন করে না। ফলে তারা নজরদারিতে পড়ে যায়।
লুক্সেমবার্গ থেকে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজে আত্তার আল জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলের সম্ভবত ইরানের অভ্যন্তরে ৩০ থেকে ৪০টি সেল কাজ করছে। তিনি বলেন, এসবের বেশিরভাগই সহযোগীদের নিয়ে গঠিত। তারা কেউ সরাসরি ইসরায়েলি নয়। এদের মাধ্যমে ইরানকে দুর্বল করে ফেলছে।
তিনি বলেন, সেলগুলোর মধ্যে কিছু ইসরায়েল থেকে অস্ত্র পাচারের জন্য, কিছু আক্রমণ পরিচালনার জন্য এবং কিছু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য পরিচালিত হচ্ছে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা কার্যক্রম ইরানের অভ্যন্তরে নতুন নয়। বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব থেকে দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ, অনুপ্রবেশ, ধ্বংস এবং ক্ষতিসাধনের জন্য পরিকল্পিত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা আলী লারিজানি ইরানে ইসরায়েলি কার্যক্রমের বিস্তৃতি স্বীকার করেন। তিনি আইএসএনএ সংবাদ সংস্থাকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুপ্রবেশের সমস্যা খুবই গুরুতর হয়ে উঠেছে। বছরের পর বছর ধরে কিছু অবহেলার ঘটনা ঘটেছে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের সাপ্লাই চেইনের অনুপ্রবেশের পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ব্যবহৃত যোগাযোগ ডিভাইসগুলোর বিস্ফোরণ সম্ভব হয়েছিল। একইভাবে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ড গোয়েন্দা এজেন্টদের মাধ্যমে অবস্থানের বিস্তারিত তথ্য প্রাপ্তির পরই পরিচালিত হয়। একই ধরনের কৌশল ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল। তার বাসভবনে কয়েক সপ্তাহ আগে স্থাপিত একটি বিস্ফোরক ডিভাইসের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়।
গত দুই দশকে ইসরায়েল ইরানের বেশ কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম মোহসেন ফাখরিজাদেহ রয়েছেন। পিকআপ ট্রাকের পিছনে মাউন্ট করা রিমোট-নিয়ন্ত্রিত বন্দুকের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া ইসরায়েল ২০১০ সালে স্টাক্সনেট কম্পিউটার ভাইরাস প্রকাশের জন্যও দায়ী ছিল। ধারণা করা হয়, এর মাধ্যমে ইরানের কমপক্ষে ১৪টি পরমাণু স্থাপনায় ৩০ হাজার কম্পিউটারকে সংক্রমিত করেছিল।
ইরান কি ইসরায়েলের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করে?
গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত সাত ইসরায়েলি নাগরিককে ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির সন্দেহে গ্রেপ্তার করে। এর একদিন আগে হাইফায় আরেকটি সাতজনের একটি দলকে আটক করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন সময়ে ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
সেই সময়ে ইসরায়েলি পুলিশ সূত্র জানায়, ইরানের সঙ্গে সম্পর্কিত অতিরিক্ত গোপন নেটওয়ার্ক দেশের মধ্যে সক্রিয় থাকতে পারে।