Image description
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে, তা বিশ্বকে স্বস্তি দিয়েছে। দৃশ্যমান সংঘাত শেষে এখন এর লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ইরানের পরমাণু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া আর আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে ১৩ জুন নজিরবিহীন হামলা চালায় তেল আবিব। উদ্দেশ্য হাসিলে সর্বাধুনিক অস্ত্রের অধিকারী মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকেও নামাল তারা। তবে সে টার্গেট অধরা! উল্টো ইসরায়েলের গর্বের প্রতীক আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে দেশটির কেন্দ্রস্থলে বৃষ্টির মতো হামলে পড়ে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন। প্রথম দিনের আকস্মিক আঘাত সামলে এমন অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানো তেহরানের তৎপরতা সবাইকে বিস্মিত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের কৌশলের কাছে কার্যত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল। যুক্তরাজ্যের বাকিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি গ্লেস বলেন, এ যুদ্ধবিরতিতে সবচেয়ে বড় ‘পরাজিত ব্যক্তি’ হচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

ইরান এখন গর্ব করে বলতে পারে, তারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এবং পিছু হটেনি। তাদের সামরিক ঘাঁটিতেও হামলা চালিয়েছে। আর ইসরায়েলের গর্বের প্রতীক চুরমার করে দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলেছে, তেহরানের পাশাপাশি এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলও নিজেদের জয়ী দাবি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বলতে পারে, তারা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা দুর্বল করে দিয়েছে; ইসরায়েল দাবি করতে পারে, তারা তেহরানকে যথেষ্টভাবে দুর্বল করেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলী ভায়েজ বলেন, এখন প্রতিটি পক্ষই নিজ নিজ বিজয়ের গল্প তৈরি করে নিয়েছে এবং একই সঙ্গে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের ঝুঁকি এড়িয়ে গেছে, যার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারত পুরো অঞ্চলে, এমনকি বিশ্বব্যাপী।

গত মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নিজ দেশের ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ ঘোষণা করে বলেছেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এটি স্মরণ করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শিল্প ধ্বংস করে দিয়েছি। ইসরায়েলে সেসব ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কয়েক মিনিট আগে সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ইসরায়েলকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে ইরানের অশুভ ইচ্ছা মুছে দেওয়া হয়েছে।’

একই দিনে ইরানের সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্বের প্রশংসা করে তেহরানে বিশাল জনসমাবেশ হয়েছে। যুদ্ধবিরতিতে নিজেদের বিজয় দাবি করে উদযাপনও চলছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বস্তরের হাজারো মানুষ মধ্য তেহরানের ইনকিলাব স্কয়ারে জড়ো হয়ে ইসরায়েলি হামলা প্রতিরোধে ও নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাদের প্রতি তাদের সমর্থন জানান।

বিক্ষোভকারীরা ইরানে এ হত্যাযজ্ঞের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেও দায়ী করেন। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান দেন এবং বলেন, ‘কোনো আপস করা হবে না। আত্মসমর্পণ করবে না। লড়াই চলবে।’ এমন পরিস্থিতিতে বাস্তবতা হলো—ইসরায়েলের ইরান যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল উপসাগরীয় দেশটির পরমাণু কর্মসূচি ‘সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া’ ও বর্তমান শাসককে ‘ক্ষমতাচ্যুত’ করা। কিন্তু ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বিশ্বের সেরা শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েও তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি।

মঙ্গলবার আলজাজিরার এক মতামতে ইরান বিশেষজ্ঞ ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ধারণা করা হচ্ছে—ফর্দো পরমাণুকেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্র বোমা ফেলার আগেই ইরান পরিশোধিত ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলেছে। এ ইউরেনিয়াম ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার মতে, ইরান যদি নিজে থেকে অন্য দেশের প্রতিনিধিদের পরমাণুকেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের অনুমতি না দেয়, তাহলে সেগুলোর কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা কারও পক্ষে জানা সহজ নয়।

ইরানের শাসক বদলানোর ইসরায়েলি লক্ষ্য সম্পর্কে এই বিশেষজ্ঞের ভাষ্য— এ ভাবনার বিরোধিতা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তেহরানে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল তেল আবিব। সেই লক্ষ্য পূরণে ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। শুধু তাই নয়, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার মাধ্যমে ইরানে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টাও করে ইসরায়েল; কিন্তু তা কাজে আসেনি।

বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ মনে করেন, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইসরায়েলি সরকার ‘সাফল্য’ না পেলেও সারাবিশ্ব থেকে নিজেদেরকেই ‘বিচ্ছিন্ন’ করতে পেরেছে। গাজায় তাদের চলমান হত্যাকাণ্ড থেকে অনেকের দৃষ্টি ফেরাতে পেরেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো উসকানি ছাড়াই ইরানে হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ‘ধ্বংস’ হয়ে যাওয়ার দাবি বারবার করলেও মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে—সর্বশক্তি দিয়ে হামলা চালিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারেনি। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইরানে শক্তিশালী ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র হামলা করায় সারাবিশ্ব তেহরানকে ‘আক্রান্ত’ এবং ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আগ্রাসী’ হিসেবে তুলে ধরেছে। এ যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো শেষদিকে ইসরায়েলের কাছে ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রের সংকট ছিল ও দ্রুত সেগুলো তৈরি করারও কোনো আশা ছিল না। ইসরায়েলি অর্থনীতি দ্রুত স্থবির হয়ে পড়ছিল। অন্যদিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন উৎপাদন, পরিচালনা ও প্রযুক্তির সব নিজেদের হওয়ায় ইরানের কাছে যথেষ্ট মজুত ছিল। ইসরায়েলের হামলায় ইরানে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও এই বিষয়টি যুদ্ধক্ষেত্রে ইরানকে এগিয়ে রেখেছে।

ইরান সফলভাবে যুদ্ধ ‘ছড়িয়ে’ দিতে পেরেছে। কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে তেহরান শুধু নিজের সক্ষমতাকেই তুলে ধরেনি, ওয়াশিংটনকে বাধ্য করেছে তেল আবিবের ‘রাশ’ টেনে ধরতে। ইরান নিজেকে যেভাবে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে চেয়েছিল, সেভাবেই পেরেছে। ইরান এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতেও সবলে দাঁড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা প্রবল।

যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি গ্লেস দ্য মিররকে বলেছেন, আমরা যা দেখছি—এ মুহূর্তে বলতে পারি, ইরান সরকারই বিজয়ী। ট্রাম্পও নয়, নেতানিয়াহু তো অবশ্যই নয়।

এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অর্জনও হয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে ২২ জুন ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২৪ জুন যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিজ দেশেই বোমা হামলার সমালোচনার মুখে পড়া ট্রাম্প এখন নিজেকে শান্তিদূতের ভূমিকায় তুলে ধরতে পারছেন। এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সেনা হারায়নি, নিজেদের সামরিক শক্তি দেখিয়েছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও দাবি করতে পারছে—এ যেন ট্রাম্পের জন্য কৃতিত্ব দাবির মোক্ষম সময় হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অর্জন যুক্তরাষ্ট্রকে এই সংঘাতে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িয়ে ফেলা। যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে চালানো বিমান হামলা শুধু তেহরান নয়, পুরো বিশ্বকে এ বার্তা দিয়েছে যে, ওয়াশিংটন নিরঙ্কুশভাবে তেল আবিবের পাশে আছে। ভূরাজনৈতিকভাবে এ অবস্থান ইসরায়েলের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল করেছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও এর প্রভাব পড়বে।