
ইরানি পরমাণু কেন্দ্রে মার্কিন হামলা ঘাঁটিতে নিরাপত্তা জোরদার, ইসরায়েলে ফের ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের, হরমুজ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন, ট্রাম্পকাণ্ডে বিস্ময়
শেষ পর্যন্ত ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে। রবিবার দিনগত মধ্যরাতের পর ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় বাংকার বাস্টার বোমা হামলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই নতুন প্রেক্ষাপটের সূচনা করেছে। এই হামলার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। রাশিয়া বলেছে, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এদিকে পাল্টা হামলার আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো মার্কিন ঘাঁটিসহ খোদ যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আরেক খবর অনুযায়ী, ইরানে মার্কিন হামলার পরপরই ইরান থেকে একের পর এক ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায় আঘাত হানে। এতে ব্যাপক ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। গতকাল দিনভর এসব স্থাপনায় আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সূত্র : আলজাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এগুলো হলো নাতাঞ্জ, ফরদো ও ইসপাহান। এর মধ্যে ফোরদো স্থাপনায় ছয়টি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান উড়ে গিয়ে ১২টি ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা ফেলেছে। একই সময় মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে ৩০ ‘টিএলএএম’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও নিক্ষেপ করা হয় ইরানের নাতাঞ্জ আর ইসপাহান পারমাণবিক স্থাপনায়। পাশাপাশি একটি বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান নাতাঞ্জে দুটি বাংকার বাস্টার বোমা ফেলে। সংশ্লিষ্ট এক সামরিক কর্মকর্তা বোমা ও বিমানের পরিচিতি দিয়ে জানান, বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা বহনে সক্ষম। এই বোমা বাংকার বাস্টার নামে পরিচিত। বি-২ বিমান থেকে এ বোমা ফেলে ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার লক্ষ্য ছিল। হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিবৃতি দিয়ে জানান, সফল অভিযানের মধ্য দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইরান বলেছে, মার্কিন হামলায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তা ছাড়া যে তিন স্থাপনায় হামলা করা হয়, সেগুলোতে কোনো পরমাণু সরঞ্জাম ছিল না। যা ছিল তা আগেই সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে মার্কিন হামলায় কোনো তেজস্ক্রিয়তার ঘটনা ঘটেনি। হামলার ব্যাপারে তেহরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা ‘অ্যাটমিক এনার্জি অরগানাইজেশন অব ইরান’ (এইওআই) বলেছে, মার্কিন হামলা আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) লঙ্ঘন। সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মার্কিন হামলার পর পাল্টা হুংকার এসেছে ইরানের দিক থেকেও। ইরান পাল্টা জবাবে ওই অঞ্চলের মার্কিন সামরিক স্থাপনাকে টার্গেট করতে পারে। ইরান আগেই সতর্ক করেছিল, যে কোনো মার্কিন হামলা আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে এবং ইরান এর উচিত জবাব দেবে।
এদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, মার্কিন হামলার পর ইসরায়েল তার নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে। ইসরায়েল সারা দেশে জননিরাপত্তা বিধিনিষেধ কঠোর করেছে। নতুন বিধিনিষেধের মধ্যে ‘শিক্ষা কার্যক্রম, জমায়েত এবং কর্মস্থলে যাওয়া’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যা ইরানে মার্কিন হামলার পরপরই কার্যকর হয়েছে।
সিএনএনের বিশ্লেষণ বলছে, ইরান আগেই হুমকি দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে জড়ালে তারা মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে টার্গেট করবে। মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত ১৯টি অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যেমন বাহরাইন, মিসর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। সবচেয়ে স্পষ্ট টার্গেটগুলোর মধ্যে একটি হলো মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম বহরের সদর দপ্তর, যেটি বাহরাইনের মিনা সালমানে অবস্থিত। আশঙ্কা করা হচ্ছে এবার ইরান এবং তার মিত্র গেরিলা সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুট হরমুজ প্রণালিতে আঘাত করতে পারে। এটি পারস্য উপসাগরকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং এই পথ দিয়ে বিশ্বের ৩০ শতাংশ তেল পরিবহন হয়।
মার্কিন হামলায় ইরানের ক্ষতি হয়নি : যুক্তরাষ্ট্র আচমকা ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইসপাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। ফোরদো তেহরানের দক্ষিণে পাহাড়ের গভীরে। এটি ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তবে হামলায় ওই স্থাপনার ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ফোরদো যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে সংযুক্তকারী চ্যানেল টানেলের চেয়েও গভীরে অবস্থিত। এই স্থাপনাটি এতটাই গভীরে যে একে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র ‘জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি)’ নামের বিশেষ বাংকার-বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে। বোমার ওজন প্রায় ১৩ হাজার কেজি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ৬০ ফুট কংক্রিট বা ২০০ ফুট মাটি ভেদ করে বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। ফোরদোর টানেলগুলো অনেক গভীরে থাকায়, এমওপি বোমা দিয়ে সফলতার শতভাগ নিশ্চয়তা না থাকলেও এটিই একমাত্র বোমা যা এর কাছাকাছি আঘাত হানতে পারে। মার্কিন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, হামলায় এমওপি বোমাই ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে হামলার প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত স্পষ্ট নয়। কারণ পরমাণু স্থাপনায় হামলার কারণে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হওয়ার কথা, কিন্তু তা হয়নি। আবার মাঠের ও বিকিরণের তথ্যে দেখা গেছে, কোনো দূষণের তথ্যও পাওয়া যায়নি। এমনকি এই স্থাপনাগুলোর আশপাশের বাসিন্দাদের কোনো বিপদ ঘটেনি। সৌদি আরব ও জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থাও বলছে, হামলার পর রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তার ঘটনা ঘটেনি। যদিও ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলের ডেপুটি পলিটিক্যাল ডিরেক্টর হাসান আবেদিনি বলেছেন, হামলার কিছু সময় আগেই ইরান তিন পারমাণবিক স্থাপনা খালি করে ফেলেছিল। রাষ্ট্রীয় টিভিকে তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও আগেই সরিয়ে নেওয়ায়’ ইরানের বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য : ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাগচি। তিনি এই হামলাকে ‘গর্হিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। আরাগচি বলেন, ইরান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব বিকল্প সংরক্ষণ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, এই ঘটনাগুলো ভয়াবহ এবং এর পরিণতি চিরস্থায়ী হবে। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যকে এই অত্যন্ত বিপজ্জনক, আইনহীন এবং অপরাধমূলক আচরণের জন্য সতর্ক থাকতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন আরাগচি।
প্রসঙ্গত ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে বর্তমানে ইস্তাম্বুলে অবস্থান করছেন আরাগচি। গতকাল ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে আব্বাস আরাগচি বলেন, ‘আমি আগামীকাল (সোমবার) রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করব এবং আমরা একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব।’ জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর গতকালই মস্কোর পথে রওনা হন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি।
আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলোর সতর্কতা : ইরানে মার্কিন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ স্থান এড়িয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলো। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং ইসরায়েলের আকাশসীমার ওপর দিয়ে কোনো বিমান চলাচল করছে না। বাড়তি সময় ও জ্বালানি খরচ করে হলেও তারা উত্তর দিকে কাস্পিয়ান সাগর এবং দক্ষিণ দিকে মিসর ও সৌদি আরব হয়ে যাতায়াত করছে। ফ্লাইটঝুঁকিসংক্রান্ত তথ্য যাচাইকারী একটি প্রতিষ্ঠান সেইফ এয়ারস্পেস সতর্ক করে বলেছে, ইরানে হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান সংস্থাগুলোর ওপর ঝুঁকি বাড়তে পারে।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা চালানোর খবর প্রচার হতেই বিশ্বব্যাপী মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘অভিনন্দন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প! ন্যায়ের শক্তি নিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত ইতিহাস বদলে দেবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্রকে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তৈরিতে বাধা দিয়েছিলেন, ইতিহাসে সেটা লেখা থাকবে।’ অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাগচি জানান, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর আত্মরক্ষার সব রকম বিকল্প ব্যবহারের অধিকার তাদের রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাদের এই পদক্ষেপের চিরস্থায়ী ফল ভোগ করতে হবে।’
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে ইরানে মার্কিন এই হামলাকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন বলেও অভিহিত করেছে মস্কো। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যে কোনো যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, একটি সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানোর মতো এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার স্পষ্ট লঙ্ঘন।’ বিবৃতিতে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের ঝুঁকি অত্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ স্টেট দুমার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রধান লিওনিদ বলেন, এই উত্তেজনার ফলাফল শুধু এই অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ওয়াশিংটন জানে, তেহরানের জবাব অবধারিত। এসব কিছু সংঘাতের চক্রকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে চীন। এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বেইজিং বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে অবিলম্বে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইরানে মার্কিন হামলা এবং আইএইএর নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমাবর্ষণের কঠোর নিন্দা জানায় চীন।’ বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের কার্যকলাপ জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য, নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করেছে। এই হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।’ মার্কিন হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান জিল বলেছেন, ইসরায়েলের অনুরোধে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর মার্কিন হামলার নিন্দা জানাচ্ছে ভেনেজুয়েলা। মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে কূটনৈতিক আলোচনায় বসার আহ্বান জানাচ্ছে মেক্সিকো। আঞ্চলিক সব পক্ষের শান্তিমূলক সহাবস্থান নিশ্চিত করা মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কিউবা বলেছে, ‘ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমাবাজির আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। এতে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসি পদক্ষেপ মারাত্মকভাবে জাতিসংঘ সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে এবং পুরো মানবসভ্যতাকে অপূরণীয় পরিণতির দিকে ঠেলে নিচ্ছে।’ রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ‘ট্রাম্প, যিনি শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন একটি যুদ্ধের সূচনা করলেন। এই ধরনের সফলতার মাধ্যমে, তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার জিততে পারবেন না।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।’ তিনি ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরার ও এ সংকটের একটি কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছার আহ্বান জানান। অস্ট্রেলিয়া সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি।’ নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সামরিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ উত্তেজনা যাতে আর না বাড়ে, তা নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ চিলির প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বোরিক বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে এ হামলা অবৈধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘আমরা শান্তি চাই এবং শান্তি প্রয়োজন।’ সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, রিয়াদ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, বিশেষ করে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিষয়টি। বিবৃতিতে উত্তেজনা কমাতে সংযম প্রদর্শন এবং সংঘাত এড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এ সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছার প্রচেষ্টা জোরদার করার আহ্বানও জানিয়েছে সৌদি আরব। এ ছাড়া ওমান ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে অবৈধ আগ্রাসন বলে উল্লেখ করে এ কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। কাতার বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এ অঞ্চলে যে বিপজ্জনক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ইরাক প্রতিবেশী ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে।
মার্কিন হামলার পর দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ : ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে দফায় দফায় ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রাথমিকভাবে আনুমানিক ৩০টি রকেট ছোড়া হয়েছে। এসব হামলা মূলত ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি ও কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুগুলোর দিকে চালানো হয়েছে।
আরেক খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরসহ অন্তত ১০টি স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইরান। বিমানবন্দর ছাড়াও ইরানি হামলার লক্ষ্যে ছিল সাপোর্ট বেইজ, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার এবং একটি জৈব গবেষণাগার। এ বিষয়ে ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থার মুখপাত্র বলেছেন, ইসরায়েলের ১০টি স্থানে রকেট ও গোলা হামলা হয়েছে। কারমেল, হাইফা, তেল আবিব ও ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে এসব হামলা হয়েছে। এ অবস্থায় দেশটির বেশির ভাগ এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে ইসরায়েলব্যাপী সতর্কসংকেত জারি হয়েছে এবং তেল আবিবসহ দেশের একাধিক স্থানে বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলি জরুরি পরিষেবা সংস্থা ‘মাগেন ডেভিড অ্যাডম’ জানিয়েছে, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর রবিবার সকালে ইসরায়েলের তেল আবিব, হাইফা, কারমেলসহ উত্তর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরের ১০টি লক্ষ্যবস্ততে সফলভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরান। এসব হামলায় তেল আবিবে বেশ কয়েকটি ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় দিনভর আগুন জ্বলেছে।
এদিকে ইরানের অভিজাত সামরিক বাহিনী ইসলামি বিপ্লবী গার্ড (আইআরজিসি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা এ দফায় ইসরায়েলের ওপর হামলায় নিজস্ব উৎপাদিত ‘খাইবার’ নামের শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এই প্রথম আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে ক্ষেপণাস্ত্রটির সর্বোচ্চ গতি বায়ুমণ্ডলের বাইরে পৌঁছে ম্যাক ১৬ (শব্দের গতির ১৬ গুণ) এবং বায়ুমণ্ডলের ভিতরে ম্যাক ৮ পর্যন্ত যেতে পারে। এমন গতিতে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রকে থামানো প্রচলিত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পক্ষে কঠিন।