Image description

ফিলিস্তিনের গাজায় হামলার ৫৯২ দিন পার করেছে ইসরাইল। মাসের হিসেবে যা ১৯ মাসের বেশি। এ সময়ের মধ্যে উপত্যকাটির নারী, শিশু ও বেসামরিকদের ওপর সভ্যতার সবচেয়ে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তেল আবিব। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাসের ন্যায্য হামলার পর এমন নারকীয় হামলা শুরু করেছে ইসরাইল। এতে এখন পর্যন্ত ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন লাখেরও বেশি মানুষ। এ ছাড়া গাজার অর্ধেকের বেশি মানুষ নিজের ঘরবাড়ি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শিশুদের অবস্থা করুণ। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করতে দিচ্ছে না ইসরাইল। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, পানি উত্তোলন কেন্দ্রগুলোতে যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা না হয়, তাহলে গাজায় অচিরেই পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে টানা হামলার অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে গাজার বিভিন্ন এলাকায় হামলা আরও তীব্র করেছে ইসরাইল। তারা গাজার ভূখণ্ডে মুহুর্মুহু বোমা ফেলছে। যাতে ৮৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও শতাধিক মানুষ।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবর, গাজার উত্তরের বেইত লাহিয়া শহরের ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল এবং আশপাশের আবাসিক এলাকায় চালানো হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, জীবিতদের চেয়ে এখন মৃতদেহই বেশি উদ্ধার হচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই দীর্ঘ সংঘাতের ফলে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৩ হাজার ৭৬২ জন ফিলিস্তিনি। আহতের সংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার ১৯৭ ছাড়িয়ে গেছে। তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস মনে করছে, এই সংখ্যা বাস্তবে আরও অনেক বেশি হতে পারে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা হাজার হাজার মানুষকে মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, মোট প্রাণহানির সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

টানা যুদ্ধ, সীমান্ত অবরোধ এবং অবকাঠামোগত ধ্বংসের কারণে গাজা বর্তমানে এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। ইসরাইল সীমিতভাবে ১০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিলেও, জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, এই সহায়তা ২১ লাখ মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। সংস্থাটির মুখপাত্র বলেছেন, এটি বিশাল মরুভূমিতে এক ফোঁটা জলের মতো। চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থা আরও ভয়াবহ। কার্যকর হাসপাতালের সংখ্যা এখন মাত্র দুটি। জ্বালানির ঘাটতিতে অনেক জরুরি সেবাও বন্ধ হয়ে গেছে। প্যালেস্টাইন রেডক্রিসেন্ট সতর্ক করেছে যে, তারা হয়তো অচিরেই সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হবে।

গাজায় ইসরাইলি অভিযান নিয়ে বিশ্ব সমপ্রদায়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বৃটেন, ফ্রান্স ও কানাডা ইসরাইলের সামরিক কার্যক্রমের সমালোচনা করেছে। তারা গাজায় বেসামরিক মানুষের ওপর অতিরিক্ত সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। এদিকে এ তিন দেশের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বলেছেন, এমন প্রতিক্রিয়া ‘মানবতার বিপক্ষে অবস্থান’ নেয়ার শামিল। নেতানিয়াহুর দাবি, আমরা নিজেদের রক্ষা করছি। যারা আমাদের প্রতিরক্ষা অভিযানের সমালোচনা করছে, তারা সন্ত্রাসের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। 

ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধানসহ দুই শীর্ষ কমান্ডারকে একটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে হত্যা করেছে। হামাস এই বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে তারা গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে রকেট হামলার মাধ্যমে পাল্টা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তারা ইসরাইলের অভিযানের সমালোচনা করে বলেছেন, এই যুদ্ধের নামে শিশু, নারী এবং নিরস্ত্র জনগণের ওপর অতিরিক্ত সহিংসতা চালানো হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল। 

চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন। তার ভাষায়, আমরা দক্ষিণ গাজায় একটি বৃহৎ নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করবো, যেখানে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য স্থানান্তরিত হবে। অন্যান্য অঞ্চলে আমাদের অভিযান চলবে। এই পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে। অনেকেই এটিকে ‘জোরপূর্বক স্থানান্তরের’ নামে গাজা দখলের একটি কৌশল হিসেবে দেখছেন। গাজায় ইসরাইলি হামলার ৫৯২ দিনের প্রায় প্রতিটি দিনই ইতিহাসে রক্তের দাগ যোগ করেছে। মানবিক বিপর্যয়, আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে তাদের হামলা বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন বিশ্ব সমপ্রদায়ের কাছে কোটি কোটি ডলারের প্রশ্ন হলো- ইসরাইলের এমন বর্বরতার শেষ কোথায়? গাজাবাসীর পরিণতি কী হবে?