
বাংলাদেশের দেশীয় খেলনা শিল্প এখন আর শুধু শিশুর বিনোদনের খাত নয়, এটি রূপ নিয়েছে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাতে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে যেমন দেশীয় খেলনার চাহিদা বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশি খেলনার জন্য তৈরি হচ্ছে বিস্তৃত সুযোগ।
একসময় দেশের খেলনার বাজারে চীনের একচেটিয়া আধিপত্য থাকলেও দৃশ্যপট বদলেছে। আনুমানিক ৭ হাজার কোটি টাকার বাজারের মধ্যে দেশীয় নির্মাতাদের দখলে রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বাজার। রাজধানী ঢাকার আশপাশে গড়ে ওঠা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৪৭টি কারখানা এখন দেশের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করছে। এর মধ্যে অধিকাংশই কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, ইসলামবাগ, চকবাজার, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, পুরান ঢাকা, ইপিজেড ও ইজেড এলাকায়।
বর্তমানে দেশেই এক হাজারেরও বেশি ধরনের খেলনা উৎপাদন হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে— শিক্ষামূলক খেলনা, প্রাণীর রঙিন মডেল, প্যাডেল কার, ট্রাইসাইকেল, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি, বৈদ্যুতিক পুতুল, প্লাস্টিক দোলনা ও দেয়াল। নতুন সংযোজিত খেলনার মধ্যে রয়েছে—কিবোর্ড, গিটার, ড্রামস, মিনি গাড়ি, অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রতিরূপ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৩ সালে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ যখন খেলনা উৎপাদনে আসে, তখন এ খাতের পেশাদারিত্বে নতুন ধারা সূচিত হয়। তাদের ‘প্লেটাইম’ ব্র্যান্ডের আওতায় এখন পাওয়া যায় শতাধিক ধরনের শিক্ষামূলক খেলনা, যেমন—পাজল, বর্ণমালা বোর্ড, গাণিতিক গেমস। আর ‘জিম অ্যান্ড জলি’ ব্র্যান্ডের অধীনে তৈরি হচ্ছে বিগ টয় ক্যাটাগরির পণ্য, যেমন—বেবি ওয়াকার, রাইডিং কার, স্লাইডার ও ট্রাইসাইকেল।
আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় খেলনা: বর্তমানে বাংলাদেশের খেলনা রপ্তানি হচ্ছে ভারতের সেভেন সিস্টার্স, নেপাল, ভুটান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সিঙ্গাপুর, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্সসহ ইউরোপ ও অন্যান্য উন্নত দেশে। ভবিষ্যতে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজারেও প্রবেশের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশি খেলনার মান, নিরাপত্তা ও মূল্য সংযোজনের দিকটি ক্রমেই উন্নত হওয়ায় ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এর চাহিদা বেড়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, চাহিদা আরও বাড়ানো সম্ভব, যদি সরকার রপ্তানি প্রণোদনা, কাঁচামালে শুল্ক ছাড় ও মান নিয়ন্ত্রণে সহায়তা দেয়।
চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা: যদিও খেলনা শিল্পের সম্ভাবনা বিশাল, তবুও উদ্যোক্তাদের সামনে রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। কাঁচামাল আমদানিতে প্রায় ৩৭ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া আধুনিক ছাঁচ নির্মাণ প্রযুক্তি, নিরাপত্তা পরীক্ষার সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলনা সনদায়নের সুযোগ এখনো সীমিত।
শিল্প মালিকরা বলছেন, খেলনা শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস, বিশ্বমানের প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষতা উন্নয়ন, কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা এবং গার্মেন্টস শিল্পের মতো সুবিধা প্রদান জরুরি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, খেলনা শিল্পকে আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্সের উপযোগী করতে হলে সরকারকে সহজ শর্তে ঋণ, অবকাঠামোগত সহায়তা এবং কার্যকর নীতিমালার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
তাদের মতে, ভবিষ্যতে পেট্রোকেমিক্যাল, সাইক্লিং, অটোমোবাইল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়বে, যা এই খাতের সম্ভাবনাকে আরও প্রসারিত করবে। তবে গার্মেন্টস খাতের মতো সুবিধা এখনো প্লাস্টিক খেলনা শিল্প পাচ্ছে না। শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য সহায়ক নীতি ও সরকারি সহায়তা অপরিহার্য বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ভূমিকা: দেশীয় খেলনার বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তারা শুধু ঐতিহ্যবাহী খেলনা তৈরি করছেন না, বরং সেগুলোকে আধুনিক নকশা এবং ধারণার সঙ্গে মিশিয়ে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করছেন, যা শহুরে ক্রেতাদেরও আকৃষ্ট করছে।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং দারাজ, ইভ্যালির মতো ই-কমার্স ওয়েবসাইটগুলো দেশীয় খেলনার প্রচার ও বিক্রির জন্য শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। এর মাধ্যমে উৎপাদকরা সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছতে পারছেন, যা তাদের পণ্য বিপণন এবং বাজার সম্প্রসারণে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
অনেক উদ্যোক্তা বিদেশি খেলনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য তাদের পণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। রঙের স্থায়িত্ব, কারুকার্যের সূক্ষ্মতা এবং উপকরণের দৃঢ়তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
সোহান টয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী কালবেলাকে বলেন, দেশীয় খেলনার বাজার ক্রমশ বড় হচ্ছে এবং এর ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। সঠিক পরিকল্পনা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনা এই শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। স্থানীয় বাজার ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারেও দেশীয় খেলনার প্রচার ও প্রসারে নজর দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ এবং অনলাইন পোর্টাল ব্যবহার করে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগলাইন ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরি করতে হবে। এই শিল্পকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। সহজ শর্তে ঋণ, কর মওকুফ এবং অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই খাতের উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা উচিত।’
ছোট খেলনার বাজারও বড় হচ্ছে: দেশের অন্যান্য খেলনার পাশাপাশি ছোট খেলনার বাজারও বড় হচ্ছে। এই ছোট খেলনার বাজারে এমন কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বছরে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি বিক্রি করে। এগুলো গত এক দশকে ছোট কারখানা থেকে বড় শিল্পকারখানায় রূপ নিয়েছে। দেশে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে এ আর প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ, আলিফ এন্টারপ্রাইজ, আমরোজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আজিজ প্লাস্টিক টয় ইন্ডাস্ট্রিজ, ঢাকাইয়া টয় ইন্ডাস্ট্রিজ এবং এভারেস্ট টয় ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
দেশে উৎপাদনের ফলে খেলনার দাম অনেক কমেছে গত কয়েক বছরে। কম দামে ভালো খেলনা মিলছে। আগে যা বিদেশ থেকে আনতে হতো, তা এখন দেশেই বানানো হচ্ছে। চীন থেকে ধারণা নিয়ে দেশে এসব তৈরি হচ্ছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশ টয় মার্চেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক জাহিদ কালবেলাকে বলেন, দেশের খেলনা বাজারের উদ্ভব বেশিদিন হয়নি। এই বাজার বছর দশেক আগেও চীনের দখলে ছিল। যেটা এখন আমরা দেশে তৈরি করেছি। বাজারটি ভালোভাবে ধরতে পারায় দ্রুত এ খাতের বিকাশ হয়েছে।
জাহিদুল হক বলেন, ‘দেশীয় খেলনা উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে মোট বাজারের ৮০ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। বিশেষ করে প্লাস্টিকের খেলনা চাহিদার পুরোটাই দেশে উৎপাদন হয়। এ ছাড়া বাইরে বিভিন্ন মেটাল, কাপড়ের বা পুরো যন্ত্র টাইপের খেলনা আমদানি হচ্ছে।’
দেশে উৎপাদনের ফলে গত কয়েক বছরে খেলনার দাম অনেক কমেছে জানিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘কম দামে ভালো খেলনা মিলছে। আগে যা বিদেশ থেকে আনতে হতো, তা এখন আমরাই বানাচ্ছি। চীন থেকে ধারণা নিয়ে দেশে এসব তৈরি হচ্ছে। একসময় দেশে এ খেলনা আমদানির প্রয়োজন থাকবে না। উল্টো দেশের এসব কোম্পানি রপ্তানি করবে বহুগুণ। খেলনা হবে দেশের আয়ের বড় উৎস। কারণ আমাদের খেলনা অনেক দেশের তুলনায় অনন্য।’
যা বলছে বিপিজিএমইএ: রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে গতকাল শুক্রবার শেষ হয়েছে দুই দিনের প্লাস্টিক খেলনা প্রদর্শনী মেলা। মেলাটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস’ প্রকল্প।
বিপিজিএমইএর সভাপতি শামিম আহমেদ বলেন, সেভেন সিস্টার্স এলাকায় পণ্য পাঠাতে হলে ভারতের অভ্যন্তরীণ পরিবহনে বেশি খরচ হয়। ফলে সেখানে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পণ্য পাঠানো ছিল অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। কিন্তু এখন যদি ঘুরপথে পণ্য পাঠাতে হয়, তাহলে রপ্তানিতে লাভ থাকবে না। ভারতে পণ্য রপ্তানি নিয়ে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নেবে এবং সেটি তারা মেনে নেবেন।
সদ্য সমাপ্ত দুই দিনের প্লাস্টিক খেলনা প্রদর্শনী মেলার গুরুত্ব তুলে ধরে শামিম আহমেদ বলেন, ‘এই মেলা পেশাদার ক্রেতা ও খেলনা শিল্পের সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সোর্সিং প্ল্যাটফর্ম। পাশাপাশি এটি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং ও প্রাসঙ্গিক তথ্য বিনিময়ের সুযোগ করে দেবে। বাংলাদেশে তৈরি খেলনার রপ্তানি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ খেলনা রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হবে ২৪ শতাংশ। সরকারের নীতিসহায়তা ও কাঁচামাল আমদানিতে কর সুবিধা পেলে দেশের খেলনা শিল্প এগিয়ে যাবে।’