
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্বের সামনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় চলে প্রেস ব্রিফিং। এতে কতসব সাফল্যের গল্প, আর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। শত শত ক্যামেরার সামনে প্রায় দিনই দুই পক্ষ যে বয়ান হাজির করে, তার অনেক কিছুই পরস্পরের সঙ্গে মিলছে না। চিরবৈরী প্রতিবেশী দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলায় যখন বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে, তখন দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বর্ণনায় শুরু হয়ে গেছে আরেকটি যুদ্ধ—তা হচ্ছে তথ্যযুদ্ধ। কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ভারত-পাকিস্তান সংঘাত ছড়ানো অপতথ্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির
৭ মে ভারতের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাল্টাপাল্টি দাবি আসতে শুরু করে, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর মাধ্যমে দুই পক্ষই নিজেদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে চায়।
যেমনটা বলা যায়—ওইদিন পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি দিল্লি। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, তিনটি যুদ্ধবিমান ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভূপাতিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোন দেশের, তারা তা এখনো নিশ্চিত করেননি। দুই দেশ এ পর্যন্ত কী কী পরস্পরবিরোধী দাবি করেছে, অতীতে তারা কীভাবে নিজেদের জনগণের কাছে বিজয়ের গল্প বলে এসেছে এবং সেসব তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করার কাজটি কীভাবে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে, তা দেখানো হয়েছে আলজাজিরার প্রতিবেদনে।
২২ এপ্রিল পেহেলগামে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। তবে তারা এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে হামলার প্রমাণ চেয়েছে। এর জেরে ৭ মে পাকিস্তান ও দেশটি নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ৯টি স্থানে হামলা চালায় ভারত। দিল্লির দাবি, তারা জঙ্গি স্থাপনায় টার্গেট করেছে। তবে পাকিস্তান বলেছে, ওই হামলায় নিহতরা সবাই বেসামরিক। এরপর পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী এক্সে দাবি করেন, ভারতীয় সেনারা কাশ্মীরের সীমান্তে সাদা পতাকা তুলেছে, যা সাধারণত আত্মসমর্পণের প্রতীক। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি দিল্লি।
এ ছাড়া হামলার বিষয়ে অনলাইনে ভুয়া তথ্যেরও ঢল নেমেছে। পাকিস্তানে ভারতের হামলার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিভিন্ন ভিডিওকে ওই হামলার দৃশ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। আর এসব ভিডিও লাখ লাখ মানুষ দেখেছে। ‘বিবিসি ভেরিফাই’ এরই মধ্যে কয়েকটি নাটকীয় ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেছে। একটি ভিডিওতে দাবি করা হয়েছিল, এটি ভারতীয় সেনাঘাঁটির ওপর পাকিস্তানের হামলার দৃশ্য। আরেকটিতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান ভারতীয় একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। আসলে সেটি ২০২০ সালে লেবাননের বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের ভিডিও।
সবচেয়ে ভাইরাল ভিডিওগুলোর একটি মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ৩০ লাখের বেশি ভিউ পেয়েছে। সেখানে দাবি করা হয়েছিল, কাশ্মীরে হামলার দৃশ্য। তবে গুগলে সেই ভিডিওর স্ক্রিনগ্র্যাব খুঁজে দেখা যায়, এটি ছিল গাজায় ইসরায়েলি হামলার ভিডিও।
বেশিরভাগ ভুল প্রমাণিত ফুটেজ ভারতীয় হামলার তাৎক্ষণিক পরবর্তী অবস্থা দেখানোর চেষ্টা করেছে। তবে বিবিসি ভেরিফাইয়ের বিশ্লেষণ করা কিছু ক্লিপ দেখে মনে হয়েছে, যেন পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া আসলে যতটা মারাত্মক ছিল, তার চেয়ে বেশি দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এক্সে ছয় লাখ ভিউ পাওয়া একটি ভিডিওর কথা বলা যায়। সেখানে দাবি করা হয়, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় ব্রিগেড সদর দপ্তর উড়িয়ে দিয়েছে।’ কিন্তু এটি ছিল আগের একটি ভিডিওর দৃশ্য।
একগুচ্ছ ছবিতে দাবি করা হয়েছিল, পাকিস্তান বিমানবাহিনী ২০২৫ সালের ৬ মে ভোরে ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, এই ড্রোন ফুটেজ আসলে একটি ভিডিও গেম ব্যাটেলফিল্ড-থ্রি থেকে নেওয়া।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা বুধবার সকালে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে। এ ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে কিছু ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে, বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমান আর সেগুলো ভারতীয় বলে দাবি করা হয়েছে। তবে বিবিসি ভেরিয়াই জানিয়েছে, ব্যাপকভাবে ছড়ানো দুটি ছবি পুরোনো। এর মধ্যে একটি ২০২৪ সালে রাজস্থানে এবং অন্যটি ২০২১ সালে পাঞ্জাবে ভারতীয় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। এর মধ্যে একটি ভিডিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেই ছড়িয়েছিল। পরে তা সংবাদ সংস্থাগুলো সরিয়ে নেয়। কারণ, সেটি ভিন্ন ঘটনার দৃশ্য ছিল। কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অনলাইনে প্রচুর ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। গত মাসে পেহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর হামলার পর এআই দিয়ে তৈরি ছবি ঘুরেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যেগুলো হামলার বাস্তব দৃশ্যকে অতিরঞ্জিত করে তুলেছিল। শুধু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই নয়, অতীতের ঘটনাগুলোও এরকম পাল্টাপাল্টি দাবি ও অভিযোগে ভরপুর, এর কোনটি সত্য—তা বোঝা কঠিন। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হন। এর জেরে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের বালাকোটে অভিযান চালিয়ে জেইএম নেতা মাসউদ আজহারসহ তাদের আস্তানা ধ্বংস করার দাবি করে ভারত। সে সময় পাকিস্তান বলেছিল, ভারতীয় বিমান হামলায় শুধু একটি নির্জন বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একইভাবে ২০১৬ সালে উরি সেনাঘাঁটিতে হামলায় ১৮ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চালানোর দাবি করলেও পাকিস্তান তা নাকচ করে বলেছিল, এটা ভারতের ‘কল্পনা’।
বেলিংক্যাট ইনভেস্টিগেশনস ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়ট হিগিন্স বলেন, ‘এটা খুব সাধারণ বিষয়—কোনো বড় ঘটনা ঘটলেই পুরোনো ফুটেজ পুনরায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যাদের পোস্টে বেশি এনগেজমেন্ট আসে, অ্যালগরিদম তাদের পুরস্কৃত করে—সত্যভিত্তিক নয়। আর যুদ্ধ ও দুর্যোগের ফুটেজ সব সময়ই বেশি আকর্ষণীয়, তা সত্য হোক বা মিথ্যা।’
ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক মাদিহা আফজাল বলেন, ভারত-পাকিস্তানের ৭৭ বছরের সংঘাতের ইতিহাসে নিজস্ব বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দুই পক্ষের জন্য মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।