Image description

‘ভূস্বর্গ’—পৃথিবীর স্বর্গ। চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মীরের এই পরিচিতি। কিন্তু স্বর্গ পাহারা দিতে কি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র আর হাজার হাজার সেনার প্রয়োজন হয়? কে জানে? তবে, ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীরে প্রয়োজন হয়। বিশ্বের যে’কটি অঞ্চল প্রচণ্ড মাত্রায় সামরিক উপস্থিতি আছে, তার মধ্যে অন্যতম কাশ্মীর।

১৯৪৭ এ ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর একাধিক যুদ্ধ, অস্থিরতার সাক্ষী হয়েছে উপত্যকাটি। যুগের পর যুগ ধরে ভারত আর পাকিস্তানের বিবাদের কেন্দ্র এটি। পাকিস্তানের মতো এত প্রকট না হলেও এই উপত্যকা নিয়ে চীনের সঙ্গেও বিবাদ রয়েছে ভারতের। কিন্তু কেন এই ভূখণ্ড নিয়ে ৩ দেশের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে উত্তেজনা? কী এমন আছে এতে?

কাশ্মীর জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় হিমালয়াঞ্চলীয় এলাকা। টলটলে পানির হ্রদ, সবুজ উপত্যকা ও বরফে ঢাকা পাহাড়ের জন্য এটি বিখ্যাত। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের আগেই এই অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। একদিন আগে স্বাধীনতা পায় পাকিস্তানও। কিন্তু কাশ্মীর? অমীমাংসিতই রয়ে যায় সেই প্রশ্ন।

সেসময় কাশ্মীরের রাজা ছিল হরি সিং। ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী বিভাজন পরিকল্পনার অধীনে, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। ভারত বা পাকিস্তান যে কারও সঙ্গে যুক্ত হতে পারত অঞ্চলটি। তবে, হরি সিং চেয়েছিলেন কাশ্মীর স্বাধীন থাকুক। কিন্তু ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার মুখে তিনি ভারতের সহায়তা চান। সেই সুযোগে কাশ্মীরের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা দখল করে নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী।

১৯৪৭ সালের পর ১৯৬৫ সালেও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। ব্যাপক প্রাণহানি হয় দু’দেশের সেনাদের। এদিকে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে ১৯৬২ সালে অঞ্চলটিতে নজর পড়ে চীনেরও। পরে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ ১৯৬৭ সালে কাশ্মীর নিয়ে সমঝোতা হয়। বিভক্ত হয়ে যায় কাশ্মীর। বিশেষ মর্যাদার শর্তে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয় জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ।

কাশ্মীরের ১ লাখ ১ হাজার ৩৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। আজাদ কাশ্মীরসহ উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের কাছে, যার আয়তন প্রায় ৮৫ হাজার ৮৪৬ বর্গকিলোমিটার। ভারত ও পাকিস্তান ছাড়াও চীনের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে এ অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা, যা আকসাই চীন নামে পরিচিত। কাশ্মীরের এই ৩৭ হাজার ৫৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে চীন।

পরে, ১৯৭২ সালে শিমলাচুক্তির মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বা লাইন কন্ট্রোল বা এলওসি মেনে চলতে রাজি হয় ভারত-পাকিস্তান। জাতিসংঘের সমঝোতা, সিমলা চুক্তির পরও ১৯৯৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে আরেক দফা যুদ্ধে জড়ায় পাকিস্তান-ভারত।

রাজনৈতিক চড়াই-উতরাইসহ নানা কারণে কাশ্মীরের বাসিন্দারাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। স্বাধীন হতে চায় তারা। ৮০ দশকের শুরু থেকেই ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র হতে শুরু করে বিক্ষোভ-আন্দোলন। উত্থান হয় অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দমন করতে ভূস্বর্গে বহু সেনা মোতায়েন করে ভারত সরকার। পৃথিবীর স্বর্গখ্যত অনিন্দ্য সুন্দর এই উপত্যকা হয়ে ওঠে মৃত্যু উপত্যকা। সন্ত্রাসী-সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্বে প্রাণ যায় হাজার হাজার বেসামরিকের।

২০১৬ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। জবাবে পাকিস্তান সীমান্তে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায় ভারত। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় নিহত হয় আরও ৪০ ভারতীয় সেনা। ভারত চুপ করে থাকবে না তা জানা কথাই। হামলা চালায় পাকিস্তানের বালাকোটে। ১৯৭১ সালের পর ২০১৯—এই সবচেয়ে বড় উত্তেজনা দেখে ভারত-পাকিস্তান।

এরপরই কাশ্মীর নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বাতিল করা হয় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা। এরপর ভারত সরকার কাশ্মীর স্থিতিশীল হয়েছে দাবি করলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। এখনো সেখানে থামেনি সহিংসতা, হত্যা।

২০০৩ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। ২০১৪ সালে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও শান্তি আলোচনার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তিনি। সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নাওয়াজ শরিফ। তিনি মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দিল্লিও গিয়েছিলেন।

কিন্তু পরের বছর, ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পাঠানকোটে এক বিমানঘাঁটিতে হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে। এরপর মোদি ২০১৭ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেন। তখন থেকেই প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে কোনো শান্তি আলোচনা এগোয়নি।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা