Image description

আজ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। আনন্দের বার্তা হলো, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশে গত ১৫ বছর পর প্রথমবারের মতো ইতিবাচক অগ্রগতি ঘটেছে! বিষয়টি অন্যভাবে বলা যাক। মূলত গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ভয়াবহভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই অর্জনের বার্তা হলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এটি বিশেষত বাংলাদেশের মতো নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের জন্য অনেক বড় একটি খবর।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে প্রধানত তিনটি পক্ষ যুক্ত থাকে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, মালিকপক্ষ ও সাংবাদিক। আঠারো শতকের শেষে নিখিল ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের সূচনা ঘটেছিল। ইংরেজ সরকার বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। দেশভাগের পরেও সংবাদমাধ্যমের ওপর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বহু চেষ্টা আমরা দেখেছি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার কায়েমের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল, সেখানেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং স্বাধীনতার পরে গঠিত শেখ মুজিব সরকারও জাতীয়করণের নামে সংবাদমাধ্যমের ওপর নজিরবিহীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বস্তুত পাঁচ দশক ধরেই ক্ষমতাসীন দলগুলো দেশে বারবার সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে।

 
 

প্রশ্ন হলো, হস্তক্ষেপের নেপথ্যে কি শুধু ক্ষমতাসীন দলগুলোই দায়ী? বিষয়টি পুরোপুরি তেমন নয়। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আমরা দেখেছি কীভাবে শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্সে দেশের অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তোষামোদ করেছিল! এতে এটাই স্পষ্ট হয়, দেশে ক্ষমতাসীন দল সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার পেছনে কোনো কোনো সাংবাদিক ও কতিপয় সংবাদমাধ্যম কর্তৃপক্ষও দায়ী।

 

এ পরিস্থিতিতে সাংবাদিক হিসেবে আমাদেরও আত্মসমালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের পরতে পরতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল নাগরিকদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে। পুঁজিবাদী বলয়ে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমের নাগরিক অধিকার, চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতার মতো মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত হতে থাকে। এতে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের অবনতি ঘটে। ফলে সাংবাদিক, লেখক ও সিভিল সোসাইটির চিন্তার স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে এসেছে। অনেকটা জর্জ ফ্লয়েডের সেই ঐতিহাসিক বার্তার মতো– আমি শ্বাস নিতে পারছি না।

 

স্বাধীনতার পর থেকে যে লুটেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার পাটাতনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের বিকাশ ঘটেছে। সুতরাং আমাদের চিন্তার পাটাতনই সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চালিত হয়নি। একটা সমাজের বিবেক নিয়ে যে জনগোষ্ঠী কাজ করে– যাদের আমরা বলি লেখকসমাজ– তারা একটি ভয়াবহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে চিন্তা করতে বাধ্য হয়। মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের এই প্রক্রিয়া যে কোনো মানুষের মধ্যে মনোবিকার ঘটায়। এ কারণে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের কোনো স্বাধীন সত্তা গড়ে ওঠেনি। এর দায় যতটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও ক্ষমতাসীন দলের, তেমনি এই বন্দোবস্ত ফলবান হতে পুষ্টি জুগিয়েছে নাগরিক সমাজ, লেখক ও সাংবাদিক মহলের একটি অংশ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত করার দুর্দান্ত সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখতে সবার আগে দরকার সাংবাদিক মহলের যৌথ তৎপরতা। সাংবাদিকরা নীতি ও নৈতিকতার ভিত্তিতে নিজেদের কণ্ঠ ও কলম জোরদার করলেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা শক্তিশালী হবে। এর জন্য সরকার ও মালিকপক্ষের সহযোগিতা প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করে তুলবে। নিজের অধিকার ও স্বাধীনতার লড়াই নিজেকে করতে হবে– এই বোধোদয় যতদিন সাংবাদিক মহলের হবে না, ততদিন তারা “দু’পয়সার সাংবাদিক” হিসেবেই কোনো রকম বেঁচে থাকবে।

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
[email protected]