
Kai Kaus ( কাই কাউস)
“... ইতোমধ্যে একদিন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এলেন। তিনি সলিমুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে ভাষণ দিলেন তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। এ ভাষণে তিনি উল্লেখ করলেন তাঁর বিখ্যাত জিরো শূন্য তত্ত্ব। তিনি বললেন, পাকিস্তানের মতো ছোট রাষ্ট্রগুলো কতগুলো গণিতের শূন্য-এর মতো। এর বাঁ দিকে যে কোনো অংক বসালেই তার অর্থ হয়। যেমন একটি শূন্যের বাঁয়ে এক বসলে ১০ হয়। অন্যথায় শূন্য হয়ে যায়। এই এক অংকটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত আমরা শূন্য থেকে যাব এবং এই অংকেই তিনি বাগদাদ চুক্তি, পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিটো চুক্তির সমর্থক। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এ ভাষণে পাণ্ডিত্য থাকলেও গ্রহণযোগ্য হলো না সাধারণ ছাত্র সমাজের কাছে। ওই সভায় আমি যাইনি। শুধুমাত্র আমাকে ঢাকা হলে বসে অনেক কথা শুনতে হলো। সকলেই জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল — আর কতদিন ছাত্রলীগে থাকবেন?
তবে এর পরেও ঘটনার বাকি ছিল। একদিন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এম এ বারী এ টি আমার রুমে এলেন। আমাকে বললেন, আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সমাবেশ ডেকেছে ফজলুল হক হল, এসএম হল, ইকবাল হলের ছাত্র সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্টরা। আলোচনার বিষয়বস্তু মওলানা ভাসানীর কথিত বক্তব্য। এই ছাত্র নেতারা নাকি কাগমারীতে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন ইউরোপ সফর শেষে মাওলানা সাহেব মাত্র দেশে ফিরেছেন, তাই নাকি ছাত্র নেতাদের তার কাছে যাওয়া। আলোচনাকালে মওলানা সাহেব নাকি ছাত্রনেতাদের কাছে ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বামপন্থী নেতা বেভানের একটি বক্তব্যের উল্লেখ করেছিলেন। ঘটনটি নিম্নরূপ –
মওলানা সাহেব আলোচনাকালে বেভানের কাছে কাশ্মীর সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মতামত জানতে চান। বেভান নাকি বলেছিলেন, 'মওলানা, কাশ্মীর দিয়ে কী হবে, তোমরা পাকিস্তান চেয়ে ভুল করেছ।' মওলানা সাহেবের কাছে এই কথা শুনে ছাত্রনেতারা মওলানা ভাসানীকে জিজ্ঞাসা করেন, 'বেভান এ কথা বলার পর আপনি কী বললেন?' মওলানা সাহেব নাকি জবাবে বলেছিলেন, 'আমার কী বলার আছে। বেভান ঠিকই তো বলেছে।'
মওলানা সাহেবের কথায় ছাত্রনেতারা ক্ষুব্ধ হয়। তারা ঢাকায় এসে প্রচার শুরু করে যে, মওলানা ভাসানী পাকিস্তান বিদ্বেষী, ভারতীয় এজেন্ট।
সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে সভা সমাবেশের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা সাহেব তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি।
বারী সাহেব বললেন, কাল আমতলার সমাবেশে মারামারি হবে।
পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর অবস্থান দুই মেরুতে। তাই মওলানা ভাসানীকে হেনস্তা করা প্রয়োজন। নইলে এই তুচ্ছ ঘটনার জন্যে মওলানা সাহেবের কথিত উক্তির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ ডাকার কোনো কারণ ছিল না। আমার কাছে ঘটনাটি স্পষ্ট হয়ে এল। বুঝতে কষ্ট হলো না যে, ছাত্রলীগের শহীদ সোহরাওয়ার্দী পন্থীরাই এ কাজটি করেছে। সংঘর্ষ অনিবার্য।
... ঘণ্টাখানেক পর সমাবেশ শুরু হলো। লক্ষ করলাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের অনেকে ছাত্র সমাবেশে এসেছে। মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগ বরাবর দুর্বল। সভার শুরুতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন সামসুল হক। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি কারো নাম উল্লেখ না করে বললেন, পাকিস্তানে কোনো মীর জাফরকে সহ্য করা হবে না। সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র কালিদাস বৈদ্য স্লোগান দিলেন — মওলানা ভাসানী জিন্দাবাদ। প্রতিপক্ষ স্লোগান দিলো — শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ — হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। সেকালে মারামারিতে বোমা-রাইফেল, পিস্তল ছিল না। তাই সংঘর্ষ হাতাহাতিতে সীমাবদ্ধ থাকল। দীর্ঘক্ষণ সংঘর্ষ চলার পর দোতলা থেকে অর্থনীতি বিভাগের ড. নূরুল হুদা ও ইংরেজির টার্নার নিচে নেমে এলেন। তাঁদের উপস্থিতিতে সবাই শান্ত হয়ে গেল।
সে সময়ের একটি ঘটনা আজও মনে পড়ছে। ছাত্রলীগের সদস্যরা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের ভারতীয় দালাল মনে করত। তাই ওই দিন ছাত্রলীগের এক সদস্য ছাত্র ইউনিয়নের এক সদস্যকে কান ধরে বলতে বাধ্য করছিল — কাশ্মীর পাকিস্তানে চাই। দৃশ্যত সংঘর্ষে ছাত্রলীগ জিতেছিল। বিকেলের দিকে আমতলায় দাঁড়িয়ে ছিল বাংলার ছাত্র সুনীল মুখোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। আমি তখন ক্লান্ত। আলোয়ান ছিঁড়ে গেছে সংঘর্ষ ঠেকাতে। সুনীল বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম — এরপর কী হবে বলুন? তিনি হেসে বললেন, আমতলায় কোনোদিন সিরাজদ্দৌলা জিততে পারে না। এরপর ছাত্রলীগে ফেরার কথা আর ভাবতে পারছিলাম না॥”
— নির্মল সেন / আমার জবানবন্দি ॥ [ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ১৪০-১৪২]