
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগের পাহাড় জমছে। প্রতিদিনই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করছেন নাগরিকরা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে ৩০০০-এর বেশি অভিযোগের আবেদন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জামুকাতেও অভিযোগ দিচ্ছেন সচেতন নাগরিকরা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই এখন মন্ত্রণালয়ে তাদের সনদ ফেরত দিচ্ছেন। কেউ কেউ লজ্জিতবোধও করছেন ভুয়া সনদের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই করছে খবর পেয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে শুরু করে। এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী আগামী একমাসের মধ্যে কেবিনেটে উঠবে বলে সূত্র বলছে। সূত্র: মানবজমিন
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা এক কর্মকর্তাকে বলছেন, আমরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দেখতে চাই না। যারা দেশের জন্য নিবেদিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তার সঠিক সংখ্যা দেখতে চাই। মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে চাই। দ্রুত আইন সংশোধন করে যাচাই-বাছাই করে তালিকা চান ওই মুক্তিযোদ্ধা।
এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগের স্তূপ বাড়ছে। প্রতিদিনই মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন নাগরিকরা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে ৩০০০-এর বেশি অভিযোগ পড়েছে। এ ছাড়াও কেউ কেউ জামুকাতেও অভিযোগ করছেন। আবেদন পাওয়ার পর এগুলো যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে। সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বসে তা ঠিক করবে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া ৯০ হাজারের উপরে কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা জমা পড়েছে। আছে নানা জাল-জালিয়াতির অভিযোগও। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সনদ ফেরত দিতে আবেদন করা ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা আবেদন করেছেন, নাম প্রকাশ করলে তারা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবেন।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ১১ই ডিসেম্বর নিজ দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যারা সনদ নিয়েছেন, তাদের তা ফেরত দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম লিখিয়েছেন, গেজেটভুক্ত হয়েছেন এবং সুবিধা নিয়েছেন। এটি জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এটি ছোটখাটো অপরাধ নয়, অনেক বড় অপরাধ। উপদেষ্টা আরও বলেন, আমরা একটি ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেবো, যারা অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এসেছেন, তারা যাতে স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে যান। যদি যান, তারা তখন সাধারণ ক্ষমা পেতে পারেন। আর যদি সেটি না হয়, আমরা যেটি বলেছি, প্রতারণার দায়ে আমরা তাদের অভিযুক্ত করবো। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গণমাধ্যমকে বলেন, যদি কেউ স্বেচ্ছায় সনদ ফেরত দিতে চান, সে জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে কেউ সনদ ফিরিয়ে দিলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। তিনি বলেন, যেহেতু তাদের পেছনে অর্থ খরচ হয়েছে, তাই আমার একার পক্ষে এ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। উপদেষ্টা পরিষদ থেকে এ প্রস্তাব পাস করাতে হবে। তারপর সময়সীমা বেঁধে দেয়া হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, একজন তার আবেদনে নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে লিখেছেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও প্রলোভনে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছি। এ অনৈতিক কাজের জন্য আমি লজ্জিত। আমি স্বেচ্ছায় এ সনদ ফেরত দেয়ার আবেদন করেছি।
অন্যদিকে, এর আগে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেয়ায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ৫ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সনদ বাতিল করা হয়। তারা হলেন- সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান, নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, এ কে এম আমির হোসেন ও যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদার। এই সনদ ব্যবহার করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত ১৫ই সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ঘোষণা দেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যারা সরকারি চাকরি পেয়েছেন, তাদের তালিকা করা হবে। যাচাই-বাছাই করা হবে। পরে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। চিঠিতে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন তাদের বিস্তারিত তথ্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, দপ্তর, করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মরত আছেন। সে হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৬ শতাংশ।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও এখনো পূর্ণতা পায়নি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। বিগত সব সরকারের আমলেই একের পর এক লম্বা হয়েছে এই তালিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো অবদান না রেখেই অনেকে নানা কৌশলে হয়েছেন তালিকাভুক্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্তদের সত্যতা যাচাইসহ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই করার উদ্যোগ নেয়া হয়। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আনার কাজ করছে সরকার। এই সংজ্ঞা পরিবর্তন হলে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং যারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন শুধু তারাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যারা দেশে-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ১০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও ১০ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ড ও নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করে। এই কমিটি পুনর্গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে কাজ শুরু করা হয়। এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, মূলত যারা রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কেবল তারাই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। বাকি যারা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তারা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।
জামুকা সূত্র বলছে, যেসব মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে অভিযোগ আসছে তাদের তথ্য যাচাই করতে প্রাথমিকভাবে সরজমিন শুনানি হবে। যাচাই-বাছাইয়ে ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই তালিকা যাচাই করতে গিয়ে অনেকের খোঁজ পাওয়া গেছে যারা ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। তালিকা যাচাই চূড়ান্ত হলে এসব ভুয়া সনদে বা সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেয়াদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। সেই তালিকার আলোকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ মাধ্যমে এই সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে এই অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।আস