
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছন। এর জবাব দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপরও পাল্টা শুল্কারোপ করে চীন। যার ফলে দেশ দুটির মধ্যে বর্তমানে বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। তবে শুল্ক আরোপের বাইরেও চীন আমেরিকার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আরেকটি হাতিয়ার বেছে নিয়েছে; আর তা হলো ‘বিরল খনিজ’ রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ। চীনের এই খনিজগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র অনেক নির্ভরশীল। তাই চীনের নতুন পদক্ষেপ দেশটির জন্য একটি বড় ধাক্কা। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশীয় খনিজ উৎপাদন বাড়াতে ও আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে বাণিজ্য বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তা দেশটির জন্য এতো সহজও নয়।
বিরল খনিজ কী এবং কী কাজে লাগে?
‘বিরল খনিজ’ হলো ১৭টি রাসায়নিক উপাদান, যেগুলো আধুনিক প্রযুক্তি নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও এদের অনেক উপাদান প্রকৃতিতে সহজলভ্য, তবে এগুলো শুদ্ধরূপে পাওয়া কঠিন এবং খনিজগুলোর উত্তোলন ও পরিশোধন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও পরিবেশ দূষণকারী।
নিওডিমিয়াম, ইউরোপিয়াম, ইট্রিয়াম প্রভৃতি নামের এসব খনিজগুলোর সঙ্গে আমরা হয়তো পরিচিত নই। তবে এগুলো দিয়ে বানানো পণ্যের ওপর আমরা অনেক নির্ভরশীল। স্মার্টফোন, টিভি, কম্পিউটার স্ক্রিন, বৈদ্যুতিক গাড়ি, জেট ইঞ্জিন, হার্ডড্রাইভ, স্পিকার ইত্যাদি তৈরিতে এগুলো ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও লেজার চিকিৎসা, এমআরআই এবং সামরিক প্রযুক্তিতেও এই খনিজগুলো অপরিহার্য।
চীন কীভাবে বিরল খনিজ নিয়ন্ত্রণ করছে?
বর্তমান বিশ্বে শুধু চীনের হাতেই এসব দুর্লভ খনিজ উত্তোলন ও পরিশোধনের প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) মতে, বিশ্বব্যাপী দুর্লভ খনিজ উৎপাদনের ৬১% এবং পরিশোধনের ৯২% চীনের হাতে।
এতে বোঝা যায়, চীন বর্তমানে পুরো সরবরাহ চেইন নিয়ন্ত্রণ করে এবং দেশটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে- কোন কোম্পানি এই খনিজ পাবে আর কোনটি পাবে না।
দুর্লভ খনিজ উত্তোলন ও পরিশোধনের উভয় প্রক্রিয়াই ব্যয়বহুল এবং পরিবেশ দূষণকারী। সব দুর্লভ খনিজেই তেজস্ক্রিয় উপাদান থাকে; যার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোসহ অনেক দেশই এগুলো উৎপাদনে অনাগ্রহী।
চীনের এই আধিপত্য হঠাৎ করে হয়নি। দশকের পর দশক ধরে নেওয়া কৌশলগত নীতিমালার ফলে তারা আজকের এই অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৯২ সালে চীনের নেতা ডেং জিয়াওপিং বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে তেল আছে, আর চীনের আছে দুর্লভ খনিজ।’
চীনের শ্রমবাজার তুলনামূলক সস্তা। পাশাপাশি এসব খনিজ প্রস্তুতকালে তারা পরিবেশগত মানদণ্ড তেমন বজায় রাখেনি। যার কারণে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় তারা এগিয়ে যায়।
বিরল খনিজকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চীনের নতুন সিদ্ধান্ত
ওয়াশিংটনের শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় চীন চলতি মাসের শুরুতে সাতটি ‘ভারী’ দুর্লভ খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এই ভারী খনিজগুলো প্রতিরক্ষা খাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতিতে এই ভারী খনিজগুলো তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া যায় এবং প্রক্রিয়াকরণও কঠিন; ফলে এদের মূল্যও বেশি।
চীন ঘোষণা করেছে, এখন থেকে সব কোম্পানিকে এই খনিজ ও চুম্বক রপ্তানির জন্য বিশেষ অনুমোদন নিতে হবে।
এই খনিজগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো ‘দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য’; অর্থাৎ বেসরকারি ও সামরিক উভয় খাতে ব্যবহৃত হয়।
চীন পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির সদস্য হওয়ায় এই জাতীয় পণ্যের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মতে, চীনের বাইরে এই ‘ভারী’ দুর্লভ খনিজ প্রক্রিয়াকরণের কোনো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই, যার ফলে দেশটি বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়বে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে এই বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব
২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয় বিরল খনিজের ৭০% আমদানি করেছে চীন থেকে।
এই নিষেধাজ্ঞা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্প, প্রযুক্তি উৎপাদন ও অন্যান্য উচ্চমূল্যের খাতে প্রভাব ফেলবে। রাডার, চুম্বক, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোনসহ এফ-৩৫ এর মতো যুদ্ধবিমান এই খনিজের ওপর নির্ভরশীল।
চীন বর্তমানে তার সামরিক সক্ষমতা দ্রুত বাড়াচ্ছে। আর ঠিক এই মুহূর্তে এসব বিরল খনিজ রপ্তানিতে চীনের সীমাবদ্ধতা আমেরিকার প্রতিরক্ষা খাতে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।
এছাড়াও আমেরিকার যেসব কোম্পানি এসব উচ্চ-প্রযুক্তি নিমার্ণ করে তারা কাঁচামালের সংকটে পড়বে এবং উৎপাদনের গতি কমে যাবে। পাশাপাশি মোবাইল, কম্পিউটার, গাড়ি ও সামরিক যন্ত্রপাতির দাম অনেক বেড়ে যাবে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে পারে; তবে এর জন্য প্রয়োজন সময়, প্রযুক্তি ও বড় বিনিয়োগ।
যুক্তরাষ্ট্র নিজে কেন দুর্লভ খনিজ উৎপাদন করে না?
যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র একটি দুর্লভ খনিজ খনি রয়েছে; কিন্তু দেশটি ‘হেভি’ খনিজ আলাদা করতে পারে না এবং সেগুলো প্রক্রিয়াকরণ করতে হয় চীনে। তাই দেশটি বর্তমানে বিরল খনিজের জন্য চীনের ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল।
১৯৮০’র দশকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের শীর্ষ দুর্লভ খনিজ উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু চীনের সস্তা উৎপাদনের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে বাজারে টিকে থাকতে পারেনি।
বর্তমানে চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে ট্রাম্প ইউক্রেনের সঙ্গে খনিজ চুক্তি করতে চাচ্ছে। এছাড়া ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের দিকে নজর দিয়েছেন। গ্রিনল্যান্ডের খনিজ মজুদ বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম। তবে এই দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও আগ্রাসী কূটনীতি এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খনিজ গবেষক ড. হার্পার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একদিকে চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ করছে, আবার অন্যদিকে বন্ধু দেশগুলোকেও শুল্ক ও রাজনৈতিক চাপ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।’
এই পরিস্থিতে বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
চীন দুর্লভ খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলেছে। এটি শুধু বাণিজ্য খাতে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি শিল্পের ভবিষ্যতের ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলবে