Image description
 

ভারতে বড় কোনো সন্ত্রাসবাদী হামলা হলে সাধারণত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় দিল্লি। পহেলগামের ঘটনার পরও পাঁচটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখা, আটারি সীমান্ত বন্ধ করা, পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য সার্ক ভিসা বাতিল করা এবং হাইকমিশনের সদস্য কমানো।

কেন এই সিদ্ধান্ত?

ওপি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, “এটা স্পষ্ট যে, ভারত পহেলগামের ঘটনার পর পাকিস্তানকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে। সেই বার্তা হলো, ভারত এই ধরনের কাজ সহ্য করবে না। উরির ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যত বন্ধ। পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আক্রমণের পরও ভারত ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের নানান ঘটনার পরেও ভারত আগে কখনও পানিতে হাত দেয়নি। এবার সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রেখে সেটাও দিয়েছে। ফলে এই বার্তা যথেষ্ট কড়া।”

সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “প্রতিবেশী দেশ এবার কৌশল বদল করে পর্যটকদের টার্গেট করেছে। তারা ভাবছে, এভাবে তাদের কার্যসিদ্ধি হবে।”

কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা বলেছেন, “পহেলগামের প্রতিক্রিয়ায় কূটনৈতিক সম্পর্ক ডাউনগ্রেড করা হয়েছে। ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি করা হয়েছে। এসব করে একটা বার্তা দেওয়া হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্য খুব কম হয়। ফলে তার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। প্রভাব পড়বে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখা নিয়ে।”

প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা বলেন, “ভারত যে ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে পাকিস্তানকে বার্তা দেওয়ার বিষয়টি প্রবলভাবে রয়েছে। এই জঙ্গি হামলার মধ্যে পাকিস্তানের তরফেও তো বার্তা হয়েছে, তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চায় না। তারা পর্যটকদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করতেও পিছপা হচ্ছে না। তার পাল্টা কড়া বার্তা দিয়েছে ভারত।”

সিন্ধু পানিচুক্তির বিষয়

১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানিচুক্তি হয়। তারপর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। অনেকবার সীমান্তে সংঘাত হয়েছে। পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা ভারতের সংসদ আক্রমণ করেছে বলে ভারত অভিযোগ করেছে। কিন্তু তার প্রভাব এই পানিচুক্তিতে পড়েনি। তবে পহেলগামে হামলার পর সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখার ঘোষণা দিলো ভারত। সিন্ধু মানে শুধু সিন্ধুর পানি নয়, তার শাখা নদী ইরাবতী, শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগার পানিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।”

ছয় বছর ধরে ইন্ডাস রিভার কমিশনার হিসাবে কাজ করেছেন প্রদীপ কুমার সাক্সেনা। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “ভারত যেহেতু উপরিভাগে আছে, তাই তার হাতে অনেকগুলো বিকল্প থাকবে।”

তিনি বলেছেন, “এই চুক্তি (সিন্ধু পানিচুক্তি) স্থগিত থাকলে কৃষ্ণগঙ্গা জলাধার ও জম্মু ও কাশ্মীরের অন্য জলাধারে রিজার্ভার ফ্লাশিং করা যাবে। চুক্তি মানলে তা এখন করা যেতো না। রিজার্ভার ফ্লাশিং করে ভারত সেখান থেকে পলি তোলার কাজ করে আবার জলাধারে পানি ভরতে পারে। তার জন্য বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। তখন পাকিস্তানে পানি কম যাবে।”

শ্রীরাধাও বলছেন, “পানিটা খুব বড় বার্তা। অন্যগুলো আগে হয়েছে। কিন্তু আমরা পানিতে হাত দিইনি। তাই এটা নিঃসন্দেহে বড় বার্তা।”

তবে কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা মনে করেন, “পানির বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের অসুবিধা হবে। কিন্তু ভারতকে এটাও ভাবতে হবে যে, এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো। এরপর চীনের সঙ্গে বিরোধ হলে, চীন যদি এই দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে ভারতে পানি বন্ধ করে, তখন কী হবে?”

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে আলোচনা

বুধবার ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাবেক কূটনীতিক ও সেনা অফিসাররা বলেছেন, “অতীতের মতো ভারত আবার পাকিস্তানের ওপর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতে পারে।”

অবসরপ্রাপ্ত লেফটোন্যান্ট জেনারেল এইচ এস পানাগ অবশ্য দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় লিখেছেন, “ভারত ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাঘাত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে সংঘাত অনেকটাই বাড়বে এবং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানের হাতে পরমাণু অস্ত্র আছে।”

শ্রীরাধা মনে করেন, “ভারতকে সংযত প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে। সেখানে কথা বলার, কূটনৈতিক পথে এগোনোর জায়গা থাকা দরকার। বিশ্বজুড়ে সংঘাত বাড়ছে। শত্রুতা ছড়াচ্ছে। আমার মতে, সংঘাত বাড়ানোর দরকার নেই। ভারত তো চিরকাল কূটনৈতিক পথকে গুরুত্ব দিয়েছে। জাতীয় স্বার্থেই তা দরকার।”

প্রণয় শর্মাও মনে করেন, “সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে যাওয়া ঠিক হবে না। এটা ঠিক, প্রত্যাঘাতের দাবি উঠবে। কিন্তু ভারত যে জায়গায় আছে, সেখানে সশস্ত্র সংঘাতে না যাওয়াই ভালো। তাতে আখেরে লাভ হয় না।”

প্রণয় বলেছেন, “জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীদের বিচ্ছিন্ন করা দরকার। এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়, যেখানে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। তাহলে সন্ত্রাসবাদীরা লাভবান হবে। তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।”

শরদ বলেছেন, “ভারত প্রত্যাঘাত করতেই পারে। তবে পাকিস্তানও পরমাণু শক্তিধর দেশ। তাই এটাও দেখতে হবে, পরিস্থিতি যেন হাতের বাইরে না যায়।”

কী প্রয়োজন?

প্রণয় মনে করছেন, “ভারতকে এখন এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কাশ্মীরে পর্যটকরা যান। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ পর্যটনের লাভ পাচ্ছেন। তাদের অর্থনৈতিক লাভ হচ্ছে। তাদের মনোভাব বদলাচ্ছে। তাই কাশ্মীরে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। আর কূটনৈতিক পথ আছে, সেগুলি দেখতে হবে।”

পহেলগামে পর্যটক আকর্ষক জায়গায় কেন নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি, হামলার পর সেই প্রশ্ন উঠছে। সন্ত্রাসবাদীরা আধঘণ্টা সেখানে তাণ্ডব চালিয়ে কী করে নিরাপদে ফিরে গেল সেই প্রশ্নও উঠছে। অবসরপ্রাপ্ত লেফটোন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য বলেছেন, “পহেলগাম, শোনমার্গের মতো এলাকায় স্লিপার সেল এখনো সক্রিয়। শিকড় থেকে সন্ত্রাসবাদীদের উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। তাই নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।”

সাংবাদিক শরদ গুপ্তা বলেছেন, “এই প্রথমবার কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ওমর আবদুল্লার এনসি এবং মেহবুবা মুফতির পিডিপি উপত্যকায় হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল করেছে। কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে মোমবাতি মিছিল করেছে। এই পরিবর্তনটা মাথায় রাখতে হবে।”

শরদ বলেছেন, “কাশ্মীরে কর্মরত আমার এক বন্ধু বলছিলেন, কাশ্মীরে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু থেকে এত পর্যটক এসেছেন যে মনে হচ্ছে, গোটা রাজ্যের লোক বুঝি এসে গেছে। তাছাড়া পুরো ভারত থেকে মানুষ আসছেন। এই পরিস্থিতিটা বজায় রাখাটা খুবই জরুরি।”