Image description

ছেলের শেষ কথাটা মা ঘালিয়া রাদওয়ানকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর ঠান্ডা মাথায় গুলিবর্ষণে নিহত ২৪ বছর বয়সী রিফাত রাদওয়ানের শেষ কথা ছিল, ‘আমাকে ক্ষমা করো মা।’

গত ২৩ মার্চ এক উদ্ধার মিশনে থাকার সময় এই তরুণ স্বাস্থ্যকর্মীকে তাঁর আরও ১৪ সহকর্মীর সঙ্গে গুলি করে মারা হয়। শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাদের হামলার বিবরণ রেকর্ড করে গেছেন তিনি।    

রিফাত মায়ের কাছে ওই ক্ষমা চেয়েছিলেন এ উদ্দেশ্যে যে, এতে হয়তো তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হবে। তিনি জানতেন, প্যারামেডিক হওয়ার পর মা তাঁর জন্য প্রতিদিন দুশ্চিন্তায় থাকতেন।

রিফাত মায়ের কাছে ওই ক্ষমা চেয়েছিলেন এ উদ্দেশ্যে যে, এতে হয়তো তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হবে। তিনি জানতেন, প্যারামেডিক হওয়ার পর মা তাঁর জন্য প্রতিদিন দুশ্চিন্তায় থাকতেন।

ছেলের ক্ষমা চাওয়ার কথা শোনার পর থেকে অসংখ্যবার সিক্ত নয়নে ঘালিয়া বলেছেন, ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি, ছেলে।’ মা ঘালিয়া জানতেন, দক্ষিণ গাজায় আরও ১৪ সহকর্মীর সঙ্গে নিহত হওয়ার আগে রিফাত তাঁর বিবেককে পরিষ্কার করতে চেয়েছিলেন।

মায়ের আশা, তাঁর ছেলে জানতেন, তিনি সব সময়ই তাঁকে ক্ষমা করে এসেছেন।

‘যেন চাকু দিয়ে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে’

২২ মার্চ ভোরে অন্যান্য দিনের চেয়ে খানিকটা দেরিতে ওঠেন ঘালিয়া। ঘুম থেকে জেগে রিফাতকে দেখতে ছুটে যান। কিন্তু আগেই ছেলেটা কাজে বেরিয়ে গেছে।

সেদিন রিফাতের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় ঘালিয়ার মনটা কষ্টে ভরে যায়। বলছিলেন, ‘আগের রাতে সে যখন ঘুমাচ্ছিল, আমি বারবারই তাকে দেখছিলাম।’

২১ মার্চের রাতটা ছিল অন্য দশটা রাতের মতোই। সারা দিন রোজা রেখে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতে রিফাত তাঁবুতে আসেন। ইসরায়েলের হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে এই তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা।

সাদামাটা ইফতার শেষে মা–বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন রিফাত। পরে সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন।

‘(রিফাতের নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে) আমি হন্যে হয়ে একবার এদিকে গেছি, আরেকবার ওদিকে। কেঁদেছি, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি, রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান অভিযান চালাতে ইসরায়েলকে রাজি করানোর চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু প্রতিবার তারা (কর্তৃপক্ষ) বলেছে, ইসরায়েল সহযোগিতা করতে সম্মত হয়নি। তা শুনে মানসিক যন্ত্রণায় আমি মূর্ছা গেছি।’
ঘালিয়া রাদওয়ান, নিহত স্বাস্থ্যকর্মী রিফাতের মা  

রিফাতের বাবা (৫২) আনোয়ার রাদওয়ান বলেন, ‘রিফাত ঘরে না থাকলে আমি তার জন্য খুবই শূন্যতা অনুভব করি। সব সময় অপেক্ষায় থাকি, কখন ফিরবে, আমরা গল্প করব। আমাদের সঙ্গে গল্প করতে, রাত জাগতে তাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি।’

ঘালিয়া বলেন, ‘ঘরে এলে আমি তার (রিফাত) কাপড় ধুয়ে দিতাম। বিছানা ঠিক করে দিতাম, যেন বিশ্রাম নিয়ে কাজে বেরোতে পারে।’

২২ মার্চ ভোরে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার আগে রিফাত সাহ্‌রি খেতে উঠেছিলেন কি না, নিশ্চিত না হলেও মা ঘালিয়ার ধারণা, তিনি রাতে উঠেছিলেন। সাহ্‌রি খেয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা রোজা শুরু করেন। কাজে যেতে ওই দিন সকাল ছয়টায় রিফাতের সহকর্মীরা এসে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে রাতে আর বাসায় ফেরেননি রিফাত। এর পরিবর্তে দ্রুত সাড়াদানে নিয়োজিত উদ্ধারকর্মীদের জন্য নির্ধারিত কেন্দ্রে থাকেন।

সহকর্মী ১৫ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনায় মুষড়ে পড়েন অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা
সহকর্মী ১৫ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনায় মুষড়ে পড়েন অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাছবি: এএফপি

পরদিন ২৩ মার্চ রিফাতের পরিবারকে জানানো হয়, ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং বেসামরিক প্রতিরক্ষা দলের ১৫ জন কর্মী নিখোঁজ হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলি সেনাদের অতর্কিত হামলার শিকার হয়েছেন তাঁরা।

খবরটা পাওয়ার পর থেকে আট দিন ছেলের জন্য নিরন্তর অপেক্ষা, খোদার কাছে প্রার্থনা আর তাঁকে জীবিত ফেরত পাওয়ার আশায় তাঁর পরিবারের সময় কেটেছে।

ঘালিয়া বলছিলেন, ‘(খবরটা শুনে) আমি হন্যে হয়ে একবার এদিকে গেছি, আরেকবার ওদিকে। কেঁদেছি, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি, রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি।’

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ওই কর্মীদের জন্য অনুসন্ধান অভিযান পরিচালনায় ইসরায়েলকে রাজি করানোর চেষ্টা করে গেছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবারই তারা (ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ) বলেছে, ইসরায়েল সহযোগিতা করতে সম্মত হয়নি। তা শুনে আমি মানসিক যন্ত্রণায় মূর্ছা যেতাম।’  

পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন ভোরে রেড ক্রিসেন্ট রিফাতের পরিবারকে খবর দেয়, স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুসন্ধানে অভিযান চালাতে অবশেষে ঘটনাস্থলে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেছে।

‘আমি চাই, এ পৃথিবীতে অন্য কোনো মাকে যেন এমন অপেক্ষার ঘণ্টা পার করতে না হয়’, বলছিলেন ঘালিয়া।  

খবর নিয়ে একসময় আনোয়ার তাঁবুতে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, রেড ক্রিসেন্ট দুজনের মরদেহ পেয়েছে। পরে আবার সেখানে ছুটে যান আনোয়ার। আর তাঁবুতে মরিয়া হয়ে মা ঘালিয়া প্রার্থনা করতে থাকেন, ছেলে রিফাত যেন এ দুজনের মধ্যে কেউ না হয়। এরপর আনোয়ার আবার তাঁবুতে ফেরেন। বলেন, চারটি মরদেহ পাওয়া গেছে। পরে আবারও ছোটেন। তৃতীয়বার রেড ক্রিসেন্টের কাছে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, রিফাতসহ ছয়জনের মরদেহ পাওয়া গেছে।  

রিফাতরা যে তাঁবুতে থাকতেন, সেখানে ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। তাই তাঁর বাবা আনোয়ারকে হালনাগাদ তথ্য পেতে ইন্টারনেটের সংযোগ থাকা নির্দিষ্ট শিবিরে ছুটতে হতো।

খবর নিয়ে একসময় আনোয়ার তাঁবুতে ফিরে আসেন। বলেন, রেড ক্রিসেন্ট দুজনের মরদেহ পেয়েছে। পরে আবার সেখানে ছুটে যান আনোয়ার। আর তাঁবুতে মরিয়া হয়ে মা ঘালিয়া প্রার্থনা করতে থাকেন, ছেলে রিফাত যেন এ দুজনের মধ্যে কেউ না হয়। এরপর আনোয়ার আবার তাঁবুতে ফেরেন। তিনি বলেন, চারটি মরদেহ পাওয়া গেছে। পরে আবারও ছোটেন। তৃতীয়বার রেড ক্রিসেন্টের কাছে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, রিফাতসহ ছয়জনের মরদেহ পাওয়া গেছে।  

‘আমার মনে হলো, ছুরি দিয়ে আমার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। কিন্তু আমি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। আমরা হাসপাতালে ছুটলাম’, বলেন আনোয়ার রাদওয়ান।  

আমার মনে হলো, ছুরি দিয়ে আমার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। কিন্তু আমি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। আমরা হাসপাতালে ছুটলাম।
আনোয়ার রাদওয়ান, নিহত স্বাস্থ্যকর্মী রিফাতের বাবা  

নিহত অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবারের সদস্যরাও তখন হাসপাতালে তাঁদের প্রিয়জনের মরদেহের অপেক্ষায় ছিলেন।

আনোয়ার আরও বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স আসার শব্দ শুনে আমরা সবাই হাসপাতাল থেকে সেদিকে ছুটলাম। সবাই কাঁদছিলাম। জরুরি বিভাগের কর্মীরাও তাঁদের নিহত সহকর্মীদের বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ও কাঁদছিলেন।’    

স্বাস্থ্যকর্মী রিফাত রাদওয়ান গুলিতে নিহত হওয়ার পর লাশ শেষবারের মতো তাঁর মাকে দেখতে দেননি বাবা
স্বাস্থ্যকর্মী রিফাত রাদওয়ান গুলিতে নিহত হওয়ার পর লাশ শেষবারের মতো তাঁর মাকে দেখতে দেননি বাবাছবি: এএফপি

‘ক্ষমা করো, মা’

নিখোঁজ রিফাতের খবরের জন্য অপেক্ষা করা যত যন্ত্রণার হোক, মরদেহ উদ্ধারের পর তাঁর শেষ মুহূর্তগুলোর রেকর্ড করা ভিডিওটা দেখার তুলনায় এটি কিছুই ছিল না। মরদেহ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থল থেকে এই ভিডিও ধারণ করা তাঁর মুঠোফোনটি উদ্ধার করা হয়।

নিহত হওয়ার আগে প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে রিফাতকে ভিডিওতে ঘটনার বর্ণনা করতে শোনা যায়।

ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়, উদ্ধার অভিযানে যাওয়ার সময় রিফাত ও তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ছুটে চলা অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে উদ্বেগ। অ্যাম্বুলেন্স ও সঙ্গে থাকা সিভিল ডিফেন্সের একটি অগ্নিনির্বাপক ট্রাকসহ অন্য জরুরি যানবাহন স্পষ্টভাবে চিহ্নিত ছিল এবং এগুলোর সংকেতবাতি জ্বলছিল।

ভিডিওতে ঘালিয়া তাঁর ছেলের কথা শুনতে পান। সেখানে রিফাতের কয়েকজন সহকর্মীর মরদেহও দেখা গেছে। অন্যরা বাঁচার জন্য সাহায্য চেয়ে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বেরিয়ে ছুটছিলেন। এ সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের পোশাক পরা ছিলেন তাঁরা, এ পোশাক পরিষ্কারভাবে চেনা যাচ্ছিল।

এরপর শুরু হলো গুলির শব্দ। রিফাত মাটিতে পড়ে গেলেন। তখনো তাঁর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল। তিনি বারবার কালেমা পাঠ করছিলেন। চাইছিলেন মায়ের কাছে ক্ষমা। বলছিলেন, ‘আমাকে ক্ষমা করো মা। আমি মানুষকে সাহায্য করতে চাইতাম। আমাকে ক্ষমা করো।’

অশ্রুসিক্ত ঘালিয়া আল–জাজিরাকে বলেন, ‘রিফাত জানত, আমি কতটা তার সঙ্গে জড়িয়ে আছি, তার ব্যাপারে আমি কতটা দুশ্চিন্তা করি। তাই শেষ মুহূর্তে সে এ জন্যই ক্ষমা চেয়েছে যে সে জানত, তাকে হারালে আমার হৃদয়টা টুকরো হয়ে যাবে।’