
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর থামেল এলাকা। ঠিক যেন রাজধানীর পুরান ঢাকা। সরু রাস্তা, নিত্য যানজট, রাত বাড়তেই জমে তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। তবে পুরান ঢাকার খাবার হোটেলের পরিবর্তে সেখানের আড্ডা জমে নাইট ক্লাবকে (ড্যান্স বার) ঘিরে। কোনো আয়োজন নেই, নেই কোনো উপলক্ষ্য—তবুও নানা দেশ থেকে আসা পর্যটক কিংবা তরুণ-তরুণীদের রাত-বিরাতে দেখা মেলে সেখানে। রাত যত গভীর হয়, এই আনাগোনাও সেখানে বাড়ে তত। এছাড়াও পুরান ঢাকার চকবাজারের মতো বেশ কিছু পাইকারি দোকানের জন্যও জনপ্রিয় কাঠমান্ডুর এই থামেল।
গত রবিবার (১৩ এপ্রিল) ওই এলাকায় মুসলিম টলি নামে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাটিতে লাঞ্চ করতে ইয়াসিন রেস্তোরাঁ যাই আমরা। সেখানে ঢুকতেই অভ্যর্থনা কক্ষে দুটি সোফা চোখে পড়ে; যেখানে বসে আছেন রেস্তোরাঁ মালিক মো. ইয়াসিন খান। সোফার পেছনের কক্ষেই রয়েছে একটি খাবারের ঘর, এরপর রান্নাঘর। তবে খাওয়া-দাওয়ার মূল আয়োজন দোতলায়; যেখানে খাবারের পাশাপাশি বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়।
মুসলিম টলির হোটেল ঢাকা এক্সপ্রেস। এখানে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি থাকারও ব্যবস্থা রয়েছে।
দোতলায় গিয়ে উঠি আমরা। লাঞ্চ সরবরাহ করা হয় তিনজন যুবকের মাধ্যমে। একজন নেপালি ও বাকি দুইজন বাঙালি। ২৩-২৫ বছরের যুবক তারা। তবে দু’জন বাঙালি এই কাজে (ওয়েটার) একবারেই নতুন। সেই কৌতূহল থেকেই সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে একজনকে (মো. সজীব মীর) জিজ্ঞাসা করা— কতদিন যাবত কাজ করছেন? সহজ উত্তরে জানালেন, ৭ মাস।
ইয়াসিন রেস্তোরাঁয় কাজ করা সজীব
উত্তর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেহ করতে বেগ পেতে হলো না যে, গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পলাতকদের কেউ একজন তিনি। এ সময় মোবাইল থেকে নিষিদ্ধ সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের ছবি দেখালে উত্তর মেলে, ‘হ্যাঁ! তিনি তো আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। রাতে বের হন, আড্ডা দেন। আমরাও মাঝেমধ্যে আড্ডা দিই তার সঙ্গে।’
‘‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ছাত্র জনতার ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় মামলাসমূহ পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। আপনারা দেখেছেন মামলার আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। যারা দেশে-বিদেশে পলাতক রয়েছেন তাদের অবস্থান শনাক্তসহ এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমরা কাজ করছি-ইনামুল হক সাগর, এআইজি, মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ, পুলিশ সদর দফতর
তবে শুধু ছাত্রলীগের শয়নের কথা কেন জিজ্ঞেস করলাম? সেই প্রেক্ষাপটটি একটু বলি। গত শনিবার (১২ এপ্রিল) দুপুরের ফ্লাইটে আমরা যাই নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখান থেকে ইমিগ্রেশন শেষে বাসযোগে সোজা ১০ কিলোমিটার দূরে কান্তি পথ এলাকার (থামেলের পাশে) হোটেল ইয়েলো প্যাগোডায় গিয়ে উঠি। হোটেলের রুমে চেক ইন করে সবুক খুলতেই দেখি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ভারতের কলকাতায় আছেন একটি সংবাদ। এর আগে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বহুল আলোচিত এই ছাত্র সংগঠনের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে গত ৬ আগস্ট ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আটকে দেয়। বর্তমানে তিনি জেলে আছেন।
ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি শয়ন
জানা যায়, শয়ন ৫ আগস্টের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। তাছাড়া তার বাংলাদেশি মুঠোফোন নম্বরটিও অনলাইনে সচল না। জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর যেকোনো সময় নেপালে পালিয়ে গেছেন এবং বর্তমানে তিনি কাঠমান্ডুতে থাকেন এবং সেখান নেপালী সিম ব্যবহার করছেন।
নেপালের কাঠমান্ডুস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, সেখানকার প্রবাসী ও অবস্থান করা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তের পর ছাত্রলীগের কয়েক শ নেতাকর্মী নেপালের রাজধানী ও তার আশপাশের শহরে রয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহবাজ হোসেন বর্ষণ প্রমুখ। রয়েছেন যুবলীগের একাধিক নেতাও। গত রমজানে ছাত্রলীগের ব্যানারে সেখানকার হোটেলে বেশ কয়েকটি ইফতার মাহফিলও করেছেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নেপালের কাঠমান্ডুস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসও।
ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি শয়ন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। তাছাড়া তার বাংলাদেশি মুঠোফোন নম্বরটিও অনলাইনে সচল না। জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর যেকোনো সময় নেপালে পালিয়ে গেছেন এবং বর্তমানে তিনি কাঠমান্ডুতে থাকেন এবং সেখান নেপালী সিম ব্যবহার করছেন।
নেপালের কাঠমান্ডুস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি সূত্র জানান, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন থেকে বাংলাদেশ থেকে কতজন আসা-যাওয়া করছেন সে তথ্য দূতাবাসের কাছে দেয় না। সে কারণে প্রকৃত সংখ্যাটি জানানো সম্ভব না। তবে তাদের সংখ্যা দুই থেকে তিন শর মতো হবে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি
বর্তমানে তারা কাঠমান্ডু ও আশপাশের শহরে অবস্থান করছেন। ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের অনেকেই রয়েছেন। তার মধ্যে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন। বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারও জানে।
মুসলিম টলির ইয়াসিন রেস্তোরাঁর মালিক মো. ইয়াসিন খান সেখানে ২০ বছর ধরে ব্যবসা করেন। শয়নের ছবি তাকে দেখানো হলে তিনি জানান, তাকে চেনেন। মাঝেমধ্যে সেখানে আসেনও। তার রেস্তোরাঁয় চাকরি করা সজীবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেলেটি ৫ আগস্টের আগে এসেছেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর অনেক তো এসেছে। এছাড়া রমজানে ছাত্রলীগ সেখানের হোটেলে ইফতার মাহফিল করেছে বলে জানি। তবে আমার রেস্তোরাঁয় এমন কোনো আয়োজন হয়নি।’
থামেলের একটি ড্যান্স বারের সামনে রাতে তরুণ-তরুণীদের ভিড়
ইয়াসিন রেস্তোরাঁয় কাজ করা সজীবের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের একাধিকবার সরাসরি ও মুঠোফোনে কথা হয়। পটুয়াখালী জেলায় তার বাড়ি। শুরুতে তিনি পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের পদে ছিলেন বলে স্বীকার করলেও পরবর্তীতে তার কোনো পদ নেই বলে দাবি করেন।
জবি ছাত্রলীগ নেতা বর্ষণ
সর্বশেষ আজ বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেলে তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে (শয়ন) দেখা হয় মাঝেমধ্যে। তবে আমি ৯ মাস আগে এসেছি। যেহেতু মালিকের বাড়ি আমার এলাকায় (বরিশাল), সেহেতু এখানে কাজ করি। ছাত্রলীগ করতাম তবে পদ ছিল না। নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করতাম।’
থামেলের সড়ক
রেস্তোরাঁয় কাজ করা আরেক যুবকের নাম আবির। রেস্তোরাঁয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয় তার। যদিও নাম-পরিচয় বলতে নারাজ তিনি। বাড়ি রাজধানীর মতিঝিলে, পড়তেন মতিঝিল গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলে। প্রতিবারই শুধু বলেন, ‘আপনারা যেভাবে ভিক্টিম, আমিও তেমন।’ অর্থাৎ, তিনি মনে করছেন, আমরাও দেশ থেকে ওখানে পালিয়ে এসেছি!
রাতের বেলায় থামেলের রাস্তার দৃশ্য
নেপালে পালিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় মামলাসমূহ পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। আপনারা দেখেছেন মামলার আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। যারা দেশে-বিদেশে পলাতক রয়েছেন তাদের অবস্থান শনাক্তসহ এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমরা কাজ করছি।’