Image description

যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে মঙ্গলবার ভোররাতে গাজায় দখলদার ইসরায়েলের বিমান ও ড্রোন থেকে নির্বিচার বোমা হামলা শুরুর পর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে ভয়ার্ত এক শিশুকে দৌড়ে যেতে দেখা যায়। সেসময় শিশুটির সঙ্গে কেউ ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে বিপন্ন শিশুটি তখন কেবল আল্লাহকে ডাকছিল।

বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী অনেকে এই ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইংরেজি যে ক্যাপশনটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে তার বাংলা এ রকম—'কার গতি বেশি? খোদার দিকে নির্যাতিতের জিকির, নাকি মুহাম্মদের দিকে জিব্রাইলের?'

এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া একটি কার্টুনও অনেকের নজর কাড়ে। সেখানে একজন ফিলিস্তিনি নারীকে দুইভাবে আঁকা হয়। এক পাশে দেখা যায়, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। আরেক ছবিতে সেই মা অশ্রুসজল চোখে বহন করছিলেন তার শিশুসন্তানের মরদেহ। রক্তাক্ত শিশুটির দেহে জড়ানো ছিল ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যবাহী কেফিয়াহ ও লাল-সবুজ পতাকা।

কার্টুনটি এঁকেছিলেন আলা আল লাগতা নামে এক কার্টুনিস্ট। এর নিচে আরবিতে যে ক্যাপশন তিনি লেখেন, তার ইংরেজি করা হয় এভাবে—ইন প্যালেস্টাইন, দ্য মাদার ক্যারিজ হার সন টুয়াইজ!

ছবি: এএফপি

অর্থাৎ, একজন ফিলিস্তিনি মা তার ছেলেকে দুইবার বহন করেন। একবার গর্ভধারণের সময়। আরেকবার মৃত্যুর সময়।

এই পুরো পৃথিবীর ভেতর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকা গাজাই হলো একমাত্র জনপদ, যেখানে মাতৃগর্ভেই হত্যার শিকার হয় শিশুরা। অথবা জন্মের পর মরতে থাকে গুলি-বোমার আঘাতে। আর যারা বেঁচে থাকে, তাদের মারতেও কোনো আয়োজন বাকি রাখে না ইসরায়েল। এভাবে প্রায় আট দশক ধরে ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েলিদের বন্দুক-বোমার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে এই শিশুরা।

চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতির পর গাজার শিশুদের দুর্দশা খানিকটা কমেছিল। কিন্তু যুদ্ধবিরতি বাড়িয়ে নেওয়ার আলোচনার ভেতরেই নতুন করে শুরু হওয়া হামলার ক্ষেত্রেও শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়টির ব্যতিক্রম ঘটেনি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এই হামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ৫৯১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর ভেতর শিশুর সংখ্যা ২০০। আর সবমিলিয়ে গত ১৭ মাসে নিহত ৪৯ হাজার ৬১৭ জনের মধ্যে শিশু প্রায় ১৮ হাজার।

ছবি: এএফপি

যুদ্ধে জন্ম, যুদ্ধেই শহীদ

কিংবদন্তিতুল্য ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ গাজার শিশুদের নিয়ে লিখেছিলেন—'কেবল মৃত্যুগুলোই আজ নতুন/প্রতিদিনই জন্ম নেয় যে নতুন শিশুরা/তারা ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে, মৃত্যুতে।/তাদের গণনা করা মূল্যহীন।'

১৩ মাস আগে যুদ্ধের মধ্যেই প্রথম সন্তানের জন্ম দেন আফনান আল-গানাম। তখন তার পরিবার গাজায় নিজেদের বাড়িতে বসবাস করত।

চলতি বসন্তে আফনান দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হন। এ সময় তারা তাঁবুতে থাকছিলেন। মঙ্গলবারের হামলায় তাদের তাঁবুটি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা আফনান ও তাদের প্রথম সন্তান মোহাম্মদ দুজনই নিহত হন।

বৃহস্পতিবার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) সঙ্গে কথা বলেন আফনানের স্বামী আলা আবু হেলাল। তখন কাফনে মোড়ানো ছোট্ট মোহাম্মদের মরদেহ ছিল তার কোলে। মৃত সন্তানের দিকে তাকিয়ে অসহায় বাবা তখন বলে ওঠেন—যুদ্ধের এক কঠিন সময়ে সে জন্ম নিয়েছে, যুদ্ধেই শহীদ হয়েছে।

ছবি: রয়টার্স

হামলায় একই পরিণতি হয়েছে বছর না পেরুনো ফুটফুটে শিশু বানান আল–সালোউতের। হাঁটতে শেখার আগেই মারা গেছে এক বছরের হুর-আল-সালাউত। ৯, ৮ ও ৫ বছরের হাসান, মোহাম্মদ এবং আজিজকে হারিয়েছেন বাবা কারাম তাফিক।

বিবিসি কথা বলেছে নাসের হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসক মরগান ম্যাকমোনাগলের সঙ্গে। মঙ্গলবার হামলার শুরু থেকে পরদিন মধ্যরাত পর্যন্ত টানা কাজ করেছেন তিনি। ম্যাকমোনাগলের হিসাবে, ওই সময়ের ভেতর হাসপাতালে যত হতাহত ফিলিস্তিনি এসেছেন, তাদের মধ্যে আনুমানিক ৪০ শতাংশই শিশু।

ছবি: এএফপি

'বর্বর-বেআইনি'

জাতিসংঘের ফিলিস্তিন মিশনের ভাষ্য, গাজায় ইসরায়েলের নতুন এই হামলা বর্বর ও বেআইনি। ইসরায়েলের এই হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে 'পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা' জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের গ্রহণযোগ্যতা যেটুকু আছে, তা-ও ক্ষুণ্ন করবে।

এছাড়া যুদ্ধ নতুন করে শুরু হওয়ায় গাজায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরা আবার নতুন করে সহিংসতার মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ। এক বিবৃতিতে সংস্থাটির প্রধান ক্যাথরিন রাসেল গাজার শিশুদের রক্ষার জন্য যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে পুনর্বহালের আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে আজ শুক্রবার শিশু অধিকার সংগঠন ডিফেন্স ফর চিলড্রেন, প্যালেস্টাইন (DCIP) অভিযোগ করেছে যে, ইসরায়েলি বাহিনী দখলকৃত পশ্চিম তীরে দুই ফিলিস্তিনি শিশুকে নগ্ন করে অপমান, ভীতি প্রদর্শন ও আটক করেছে। এর আগে তারা তাদের দাদিকে গুলি করে হত্যা করে।

ছবি: রয়টার্স

ডিসিআইপি জানায়, ৭ বছর বয়সী ইব্রাহিম আবু ঘালি ও ১৩ বছর বয়সী ওমর মোহাম্মদ জাবেন ১০ মার্চ জেনিনের পশ্চিমে তাদের দাদাবাড়িতে ছিল। তখন ইসরায়েলি বাহিনী অভিযান চালায়। তাদের দাদি ফজরের আযান শোনার জন্য বাইরে বের হলে ইসরায়েলি সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে।

এরপর ইসরায়েলি সেনারা বন্দুকের মুখে শিশু দুটিকে এবং তাদের দাদাকে অন্তর্বাস পরিহিত অবস্থায় দাঁড় করায়, হাত বাঁধে এবং প্রায় এক ঘণ্টা ঠান্ডায় বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে। পরে তাদের কাপড় ছাড়াই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

ডিসিআইপি কর্মকর্তা আয়েদ আবু একতাইশ বলেন, এভাবে শিশুদের নগ্ন করে রাখা, তাদের লাঞ্ছিত করা ও মানসিকভাবে আতঙ্কিত করা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণের শামিল।

ডিসিআইপির হিসাব অনুসারে, চলতি আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হয় ২০১৪ সালে। 'অপারেশন প্রোটেকটিভ এইজ' নামে পরিচিত ওই অভিযানে দুই হাজার ২৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে ৫৫১ জনই ছিল শিশু।

২০১৮ সালেও ৫৬ ফিলিস্তিনি শিশু ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত হয়। কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে তখন ডিসিআইপি জানায়, টার্গেট হওয়া শিশুগুলো ছিল নিরস্ত্র। তারা ইসরায়েল বা এর নাগরিকদের জন্য কোনো ধরনের হুমকিও তৈরি করেনি। এদের মধ্যে পাঁচ শিশুর বয়স ছিল ১২ বছরের নিচে।

ছবি: রয়টার্স

তখন এ সংক্রান্ত এক নিবন্ধে লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম-পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট মনিটরের রামোনা ওয়াদি লেখেন, 'ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা বা জখম করার মাধ্যমে এমন একটি প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে, যারা উপনিবেশবিরোধী লড়াই চালু রাখতে পারে।'

কিন্তু ধ্বংসপ্রায় ফিলিস্তিনি জাতিকে টেকাতে, অজস্র মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহীদদের শূন্যস্থান ভরাটের জন্য আরও আরও সন্তানের জন্ম দিয়ে চলে ফিলিস্তিনিরা। হত্যা আর ঘৃণার বিপরীতে বোমা-বারুদের ধ্বংসস্তূপেই ফুটিয়ে চলে ভালোবাসার ফুল।

এখানেও প্রাসঙ্গিক মাহমুদ দারবিশ। ২০০২ সালে ইসরায়েল যখন রামাল্লা আক্রমণ ও অবরোধ করে তখন তিনি লিখে ফেলেন তার বিখ্যাত কবিতা 'অ্যা স্টেট অব সিজ'। কবিতার একটি জায়গায় এক ইসরায়েলি সেনার উদ্দেশে তাকে বলতে শোনা যায়— 'হন্তারককে বলছি শোনো, তুমি যদি ভ্রূণটাকে আর/তিরিশটা দিন সময় দিতে/তাহলে সবকিছু অন্যরকম হতে পারত:/অবরোধ থাকত না, শিশুরা আর স্মরণ করত না/অবরোধকালের কথা,/একজন স্বাস্থ্যবান ছেলে হয়ে উঠতো সে,/পড়তো এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস/তোমার কোনো এক কন্যার সাথে একই কলেজে।/তাদের মধ্যে প্রেম হতে পারত।'