
মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত লেগে আছে। এখানকার রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বগুলোর ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইয়েমেন। বর্তমানে দেশটি নতুন এক সংঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। এতে শুধু ইয়েমেন নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের বৃহৎ শক্তি যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের হিসাব নিকাশ পাল্টে যাচ্ছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ ও হুতি বিদ্রোহীদের শক্তি বাড়ছে। বিশেষ করে ইরান সমর্থিত এই গোষ্ঠীর আগ্রাসী প্রভাবে ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র। তাই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাতের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী
সম্প্রতি ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। তারা দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও বিস্তৃত করেছে। বিশেষ করে, সৌদি আরবের কাছে এটি একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ সৌদি আরবের নিরাপত্তা স্বার্থ এতে সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে। হুতি গোষ্ঠীর মূল সমর্থক দেশ ইরান। এরইমধ্যে তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ২০১৪ সালে হুতিরা ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদরাব্বু মনসুর হাদিকে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। তখন থেকেই ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের উত্তাপ বাড়ে। ২০১৫ সালে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোট ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। তবে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। ফলে দেশটি বিপুল মানবিক সংকটের মধ্যে পড়ে।
ট্রাম্পের কঠোর পদক্ষেপ
চলতি বছর ক্ষমতায় এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বড় আকারে সামরিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী হুতি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান শুরু করেছে, যা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে পারে। হুতি গোষ্ঠী সম্পর্কে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা ১৯৯০-এর দশকে ইয়েমেনে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়, তবে ২০১৪ সালে সানা দখল করার পর তাদের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোচনায় আসে। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের আগ্রাসন এবং পশ্চিমা সমর্থন সত্ত্বেও, হুতিরা ইয়েমেনে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে তোলে।
হুতিরা কেন হামলা করছে
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের মধ্যে হুতিদের নিয়ে কিছু আশা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের নজিরবিহীন আক্রমণ পুরো পরিস্থিতি আরও জটিল করে। গাজার পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। বহু মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটে। এসময় হুতি বিদ্রোহীরা গাজার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট জাহাজে হামলা চালানোর হুমকি দেয়। এই হামলার পরই যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক অভিযানে তীব্রতা আনে এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড জানিয়েছে, ইয়েমেনে তারা ২৪/৭ অভিযান পরিচালনা করছে, তবে সর্বশেষ হামলা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি। এদিকে গাজার সমর্থনে হুতি বিদ্রোহীদের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রে বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) ইসরায়েলজুড়ে সাইরেন বেজে ওঠে। যদিও ইসরায়েলি বিমানবাহিনী (আইএএফ) ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসরায়েলি আকাশসীমায় প্রবেশের আগেই প্রতিহত করেছে।
গাজায় ইসরায়েলি হামলা
এদিকে গাজায় হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সব পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পাশে থাকবে। এটি দুঃখজনক যে হামাস এই যুদ্ধকে আবার শুরু হতে দিয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৯ হাজার ৫৪৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৯ জন আহত হয়েছেন। গাজার সরকার পরিচালিত গণমাধ্যম অফিস জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া হাজারো মানুষকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬১ হাজার ৭০০-তে পৌঁছাবে।
নতুন সংকট
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা ইয়েমেনের জন্য এক নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে মার্কিন হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। হুতি গোষ্ঠীও এর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, তারা মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এরইমধ্যে, ইরান তাদের সমর্থন জানিয়ে ইয়েমেনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ বিবৃতি দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইয়েমেনের প্রতিরোধ শক্তির প্রশংসা করেছেন, যা এই অঞ্চলকে আরও উত্তপ্ত করেছে।
ইয়েমেনের পাল্টা আক্রমণ
মার্কিন হামলার পর হুতি বিদ্রোহীরা পাল্টা আক্রমণ হিসেবে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যানকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। যদিও মার্কিন সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা এই হামলাকে প্রতিহত করেছে। তবে আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, হুতি বিদ্রোহীদের হামলা যদি বন্ধ না হয়, তবে তারা ইয়েমেনে তাদের অভিযান অব্যাহত রাখবে। এদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি গোষ্ঠীর চালানো যে কোনো হামলার জন্য তিনি ইরানকে দায়ী করবেন। ট্রাম্পের এ বক্তব্যে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ককে আরও তিক্ততা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইরান ও হুতি বিদ্রোহীদের সম্পর্ক
হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যা আনসারুল্লাহ নামে পরিচিত। মূলত শিয়া মুসলিম গোষ্ঠী এবং এটি ইরান প্রভাবিত অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। ইরান যেহেতু একটি শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং ইয়েমেনের শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি তার সমর্থন রয়েছে, ফলে তারা হুতিদের সমর্থন দেয়া শুরু দেয়। এমনকি হুতিদের অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে ইরান। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অভিযোগ, হুতিদের সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি সরবরাহ করে ইয়েমেনে ও গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইরান প্রভাব বাড়াতে চায়।
সংকট আরও তীব্র হতে পারে
গৃহযুদ্ধের কারণে ইয়েমেনের মানবিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরে লাখো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইয়েমেনের সংকটকে কেন্দ্র করে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুদ্ধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষ, রোগ ও বাস্তুচ্যুতি ব্যাপক বেড়েছে। নতুন করে যুদ্ধ শুরু হলে এ সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠবে এবং পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একাধিকবার উভয়পক্ষকে সংঘাত পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছে। হুতি বিদ্রোহীদের শক্তি বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার ফলে সংঘাত দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি শুধু ইয়েমেনের জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের জন্যই বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি,