
ইলোন মাস্ক পরিচালিত স্টারলিংকের মূল প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা স্টারলিংকের মূল প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স ও কাতারের রাজপরিবারের গ্লোবাল এনগেজমেন্ট অ্যাডভাইজার রিচার্ড এইচ গ্রিফিথস একটি বিশেষ সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে ইলোন মাস্ক ও স্টারলিংকের পরিকল্পনা নিয়ে বণিক বার্তাসহ আরো কয়েকটি গণমাধ্যমের সঙ্গে গতকাল কথা বলেছেন তিনি। বণিক বার্তার পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম
স্টারলিংক নিয়ে বাংলাদেশে অনেক আলোচনা। এর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলুন।
ইলোন মাস্ক পরিচালিত স্টারলিংকের মূল প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানান যে তিনি স্টারলিংকের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে যা কিছু করা প্রয়োজন, তা করবেন। এজন্য তিনি এরই মধ্যে একটি বিশেষ দলও গঠন করেছেন, যা একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত যে তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চান। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, আগামী ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে স্টারলিংকের লাইসেন্স প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। বাস্তবে হয়তো কিছুটা বেশি সময় নিতে পারে, তবে এটিই বিশ্বের দ্রুততম লাইসেন্সিং প্রক্রিয়াগুলোর একটি হতে পারে। এটি বাংলাদেশের সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করছে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে কাজ করছে।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় স্টারলিংকের কার্যক্রমের মডেলটি কেমন হতে পারে?
এটি একটি কারিগরি প্রশ্ন। স্পেসএক্সের স্টারলিংকের একটি দক্ষ দল বাংলাদেশে আসছে, যারা সরকারের সঙ্গে মিলে এটির আদর্শ মডেল তৈরি করবে। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি এবং একটি বৃহৎ দেশ। তাই সরকার ও স্টারলিংক যৌথভাবে কাজ করে সেরা সমাধান খুঁজে বের করবে।
আপনি কি বাংলাদেশে বড় ব্যবসার সুযোগ দেখছেন?
স্টারলিংক একটি বৈশ্বিক ব্যবসা, তবে এটি মূলত একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান। আমি বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশ বর্তমানে মার্কিন এবং ইউরোপীয় ব্যবসার জন্য একটি নতুন সম্ভাবনাময় গন্তব্য। বিশেষ করে নতুন সরকারের আগমনের পর পরিস্থিতি আরো ইতিবাচক হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান রয়েছে।
আমি মনে করি স্টারলিংক বাংলাদেশে আরো অনেক মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশের সূচনা মাত্র। অতীতে কিছু সমস্যার কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা করা কঠিন ছিল। এরই মধ্যে আরেকটি বিলিয়ন ডলারের মার্কিন কোম্পানিকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এটি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি কতদূর এগিয়েছে?
বর্তমানে স্টারলিংকের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রথম ধাপে স্টারলিংককে সরকারের কাছ থেকে স্পেকট্রাম লাইসেন্স পেতে হবে। একবার লাইসেন্স পেয়ে গেলে এটি স্থানীয় অপারেটরদের সঙ্গে কাজ করবে এবং একটি সমন্বিত ইকোসিস্টেম তৈরি করবে। বাংলাদেশে স্টারলিংকের লাইসেন্স পাওয়ার পর এটি একটি উন্মুক্ত মডেল হবে, যেখানে বিভিন্ন ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক এবং স্পেসএক্সের সঙ্গে কাজ করতে পারবে।
সরকার পরিবর্তন হলে এ আলোচনা কি প্রভাবিত হতে পারে?
দুর্ভাগ্যবশত রাজনীতি অনেক সময় ব্যবসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচনের সময় শক্তি ও মনোযোগের একটা বড় অংশ রাজনীতির দিকে চলে যায়, যা ব্যবসার গতিকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে বাংলাদেশে এখন যে নেতৃত্ব রয়েছে, তারা একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ আরো মজবুত হচ্ছে। ক্ষমতার এ শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনই বাংলাদেশের শক্তিকে প্রকাশ করে। তরুণ প্রজন্ম পরিবর্তন চাইলেও তারা জানে যে অভিজ্ঞতা ছাড়া দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই তারা অভিজ্ঞ নেতৃত্বকেই বেছে নিয়েছে। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। দুর্নীতির অবসান রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে সময়ের সঙ্গে এটি বাস্তবায়িত হতে পারে। আমি বাংলাদেশ ২.০ ধারণার কথা বলতে চাই—নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে। যেখানে অর্থনীতির ডিজিটালাইজেশনে স্টারলিংকের মতো প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট মূল্য কেমন হবে?
ইলোন মাস্কের স্বপ্ন ছিল বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা। তবে এর মানে এই নয় যে প্রতিটি ব্যক্তি স্টারলিংকের টার্মিনাল কিনবে। স্টারলিংকের মূল লক্ষ্য হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা। এটি মূলত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল, হাসপাতাল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজারে এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। তাদেরও ইন্টারনেট সংযোগের প্রয়োজন। তাই স্টারলিংক এমন একটি মডেল অনুসরণ করবে, যেখানে কমিউনিটিভিত্তিক ইন্টারনেট প্রদান করা হবে। হাসপাতাল, হোটেল, স্কুল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্টারলিংকের সংযোগ থাকবে, যার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে।
স্টারলিংকের প্রাথমিক মূল্য কত হবে?
এটি স্টারলিংকের ওপর নির্ভর করবে। স্টারলিংক প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা মূল্য নির্ধারণ করে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হবে। এটা আসলে ঠিক করবেন স্টারলিংকের যে প্রতিনিধিরা এটা নিয়ে কাজ করেন তারা। তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে সরকারের অতিরিক্ত ফি যেন সাধারণ জনগণের জন্য ইন্টারনেটের খরচ বেশি না বাড়িয়ে দেয়।
স্টারলিংকের একটি মডেল হলো গ্রাহকদের টার্মিনাল ভাড়া দেয়া। বাংলাদেশে এ মডেল চালু হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
ভালো প্রশ্ন। আমি মনে করি, এটি পর্যালোচনার জন্য একটি অসাধারণ দল রয়েছে। আমার ভূমিকা খুব নির্দিষ্ট। আমার ভূমিকা হলো ইলোন মাস্ক এবং নেতৃস্থানীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করে সহায়তা করা। সে আলোচনা পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন দল এতে কাজ শুরু করে। সে ধরনের দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে আমি বেশ দূরে এবং আমি প্রযুক্তিবিদও নই। আমি মনে করি এটি একটি বিশাল বাজার এবং এর জন্য খুব নির্দিষ্ট দামের প্রয়োজন হবে। তবে দামের বিষয়টি তেমন বড় সমস্যা হবে না।
তাহলে এখন কি মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে?
আমি মনে করি আপনি ধীরে ধীরে আরো বেশি করে তা দেখতে পাবেন। হ্যাঁ, আগ্রহ আবার নতুন করে তৈরি হচ্ছে। আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি দেখতে পাচ্ছি। ইলোন মাস্কের সঙ্গে কথা বলার পর অনেক মানুষ ও কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ এক ধরনের গোপন রত্ন। এটি নিজেকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করতে জানে না। আমি মনে করি, এটি একটি সংকেত যে বাংলাদেশকে আরো বেশি আগ্রাসী হতে হবে এবং কেন এ দেশে ব্যবসা করা গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করতে হবে।
আপনি জানেন, যখন আমি বাংলাদেশের জনসংখ্যার কথা বলি, মানুষ হতবাক হয়ে যায়। যখন আমি বাংলাদেশের আকার সম্পর্কে বলি, মানুষ হতবাক হয়। যখন আমি কিছু অর্থনৈতিক বিষয়, যেমন রফতানি, বস্ত্র, প্রযুক্তি হার্ডওয়্যার, ফলমূল ও সবজি ইত্যাদি সম্পর্কে বলি, মানুষ সত্যিই অবাক হয়। আমি মনে করি এর পরিবর্তন করা দরকার। বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববাজারে নিজেদের উপস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ প্রতিযোগিতা প্রচুর এবং এ অঞ্চলে বাংলাদেশকে আরো দৃঢ়ভাবে নিজেদের মূল্য বোঝাতে হবে।
স্টারলিংকের সেবার বাংলাদেশে নিবন্ধনের কতদূর অগ্রগতি করেছে?
প্রথম ধাপটি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একবার এটি থাকলে বাকিটা সহজেই হয়ে যায়। তাই এটি বড় একটি বিষয়। সরকার কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে না। বরং তারা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, যা থেকে বোঝা যায় যে এটি দ্রুত সম্পন্ন হবে। ৯০ দিনের সময়সীমা হয়তো বেশ উচ্চাভিলাষী। তবে আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে এটি গ্রীষ্মকালের মধ্যেই হতে পারে, যা একটি দুর্দান্ত বিষয়।
বাংলাদেশে স্টারলিংক ব্যবহারের ক্ষেত্রে তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ আছে কি?
আমি বুঝতে পারছি যে আপনি এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চান, তবে এখানে আমাদের নির্ভর করতে হবে কেবল বাস্তব তথ্যের ওপর। এটি অন্যান্য প্রযুক্তির মতোই; মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে স্মোক ডিটেক্টর পর্যন্ত সবকিছুই হ্যাক করা সম্ভব, তবে এটি নিয়ে বাস্তবসম্মতভাবে চিন্তা করতে হবে। কিন্তু এখানে কোনো ষড়যন্ত্রমূলক বিষয় নেই এবং আমরা বিশ্বব্যাপী এটি কার্যকরভাবে পরিচালিত হতে দেখেছি। মনে রাখবেন, স্টারলিংক বর্তমানে বিশ্বের ১১৪টি বাজারে কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। গুজব সবসময়ই থাকবে। তবে সেগুলো শুধুই গুজব। এখন পর্যন্ত এ গুজবের সপক্ষে কেউ নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারেনি।
ইলোন মাস্ক কি বাংলাদেশে আসছেন?
প্রথমত, ইলোন মাস্কের বাংলাদেশে আসার বিষয়ে বলতে গেলে, এটি দারুণ হবে। তার সঙ্গে ফোনালাপের সময় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এ সম্ভাবনা নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। আমি মনে করি, ইলোন মাস্ক বাংলাদেশে কী ঘটছে তা দেখতে খুব আগ্রহী হবেন, বিশেষত যদি স্টারলিংক বাংলাদেশে চালু হয়। তবে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত একজন মানুষ। তাই এটি প্রফেসর ইউনূস এবং ইলোন মাস্কের সময়সূচির ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু হ্যাঁ, আমি মনে করি এটি একটি দারুণ ব্যাপার হবে। ইলোন মাস্ক এবং অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একসঙ্গে থাকলে তা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্য উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত হবে। তাই আশা করি এটি বাস্তবে রূপ নেবে।