Image description

দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস নামে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনকে যেভাবে বোলান গিরিপথের কাছে দুঃসাহসিকভাবে ‘ছিনতাই’ করা হয়েছে, তাতে সারা দুনিয়াময় রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেছে। ‘বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)’ আনুষ্ঠানিকভাবে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে – এবং পাকিস্তানে ও পাকিস্তানের বাইরে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও একমত যে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই এর পেছনে আছে।

এখন প্রশ্ন হলো, বেলুচিস্তানের এই বিদ্রোহীরা কি তাদের কর্মকান্ডে প্রতিবেশী ভারতের মদত পাচ্ছে?

প্রশ্নটা এই কারণেই উঠছে যে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় ভারতের সক্রিয় সমর্থন আছে। তা ছাড়া যেভাবে সুপরিকল্পিত হামলা চালিয়ে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ব্যবহার করে একটা গোটা ট্রেনকে ছিনতাই করে কয়েকশ’ যাত্রীকে জিম্মি করা হয়েছে – তা বাইরের কোনও শক্তির সাহায্য ছাড়া আদৌ সম্ভব নয় বলে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকই মনে করছেন।

পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বিশেষ উপদেষ্টা রানা সানাউল্লাহ তো ইতোমধ্যে বলেই ফেলেছেন, ‘নিশ্চিতভাবেই এই হামলার পেছনে ভারতের হাত আছে।’ ডন পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও দাবি করেন, আফগানিস্তানের মাটি থেকেই ভারত না কি এই হামলাটি পরিচালনা করেছে।

তবে সে দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, ট্রেনের জিম্মি যাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগই পাকিস্তানি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বলে জানা যাচ্ছে। 

হামলার ঘটনাটি পাকিস্তানের যেখানে ঘটেছে। সূত্র : বিবিসি

হামলার ঘটনাটি পাকিস্তানের যেখানে ঘটেছে। সূত্র : বিবিসি

এদিকে ভারতের পক্ষ থেকে এই জাফর এক্সপ্রেস ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্যই করা হয়নি। সাধারণত বিদেশের মাটিতে কোনও বড় ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটলে সমবেদনা প্রকাশ করে ভারত সরকার বিবৃতি দিয়ে থাকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা এখনও করা হয়নি। ঘটনাটা যদি কোনও সন্ত্রাসী হামলার হয়, তাহলে নিন্দা জানানো হয় জঙ্গীবাদেরও – কিন্তু এক্ষেত্রে দিল্লির তরফে কোনও বিবৃতিই আসেনি।

ফলে এই দুঃসাহসিক হামলার ঘটনায় ভারতের ‘সহানুভূতি’ ঠিক কোন দিকে – সেটা এখনও স্পষ্ট করা হয়নি।

কিন্তু বেলুচিস্তানের এই ঘটনায় ভারতের সরাসরি যোগদান থাকুক বা না থাকুক – বেলুচ বিদ্রোহীদের প্রতি ভারতের যে সক্রিয় সমর্থন আছে, এটা বলতে কোনও দ্বিধা নেই ভারতের পর্যবেক্ষকদেরও।

মোদির ভাষণ আর বিএলএ-র কর্মকাণ্ড

দিল্লির জেএনইউ-তে অধ্যাপক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রশান্ত সাহু বেলুচিস্তান নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন, “ইন্ডিয়া’স বেলুচিস্তান ট্যাকটিক” নিয়ে একটি গবেষণাপত্রও লিখেছেন তিনি।

ড. সাহু মনে করেন, কাশ্মিরে পাকিস্তানের ‘হস্তক্ষেপে’র নীতির মোকাবিলা করতে খুব সচেতনভাবেই ভারতে বেলুচিস্তানে বিদ্রোহীদের পাল্টা মদত দেওয়ার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদে উসকানি দেওয়ার নীতি নিয়েছে – এবং আপাতদৃষ্টিতে ভারতের জন্য সেটা কাজেও দিচ্ছে।

প্রশান্ত সাহু আরও জানাচ্ছেন, বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি বা ‘বিএলএ’ নামে যে সংগঠনটি এই হামলার দায়িত্ব নিয়েছে সেটি ২০১০ সাল নাগাদ তৈরি হয়েছিল। বেলুচিস্তানের ‘শহীদ’ মাজিদ ভাইদের নামে তাদের ‘মাজিদ ব্রিগেড’ নামে একটি সুইসাইড স্কোয়াডও ছিল, যারা সাঙ্ঘাতিক সব আত্মঘাতী হামলাও চালিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ক্রমশ তাদের কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়তে থাকে।

বেলুচিস্তানে মোদির পোস্টার নিয়ে ধন্যবাদও জানিয়েছেন স্বাধীনতাকামীরা। ২০১৬

বেলুচিস্তানে মোদির পোস্টার নিয়ে ধন্যবাদও জানিয়েছেন স্বাধীনতাকামীরা। ২০১৬

“২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে লাল কেল্লার মঞ্চ থেকে প্রথমবারের মতো বেলুচিস্তানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, বেলুচিস্তান, গিলগিট-বালটিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরের লোকজনও এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। সেটা ছিল ভারতের জন্য একটা বিরাট ‘পলিসি শিফট’ বা নীতিগত পরিবর্তন, কারণ এর আগে কখনোই ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব প্রকাশ্য মঞ্চে বেলুচিস্তানের প্রসঙ্গ আনেননি।”

“এর আগে ভারত হয়তো গোপনে ইউরোপ বা আমেরিকায় বসবাসকারী বেলুচ নেতাদের টুকটাক সমর্থন দিত। কিন্তু মোদির ভাষণের বছর দেড়-দুয়েকের পরেই আমরা দেখলাম ‘বিএলএ’ আবার ভীষণ সক্রিয় হয়ে উঠেছে, ২০১৮ থেকে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একের পর হামলা চালাতে শুরু করে। ফলে অনেকেই হয়তো এই দুটোর মধ্যে সম্পর্ক টানতে চেষ্টা করবেন”, বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন অধ্যাপক সাহু।

হুসেইন হাক্কানির ‘ক্রিপটিক পোস্ট’

এরই মধ্যে পাকিস্তানি বিশ্লেষক তথা ওয়াশিংটনভিত্তিক হাডসন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো হুসেইন হাক্কানি বুধবার (১২ মার্চ) ‘এক্স’ হ্যান্ডলে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করে লিখেছেন, ‘বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ দেশগুলো হয় তাদের শত্রুকে নিরস্ত করে রাখে, কিংবা শত্রুর সঙ্গে শান্তি স্থাপনার একটা উপায় খুঁজে বের করে।’

‘অথচ পাকিস্তানিরা এই শত্রুর বিরুদ্ধে ৭৮ বছর ধরে নিন্দা করে আসছে। মাঝেসাঝে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে। কিন্তু তারা সেই শত্রুকে হারাতেও পারেনি, আবার তাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনার কোনও উপায়ও খুঁজে বের করতে পারেনি’, আরও লিখেছেন তিনি।

হুসেইন হাক্কানি

হুসেইন হাক্কানি

না তিনি কোনও ‘শত্রু’র নাম করেননি, ট্রেন ছিনতাইয়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই যে এই টুইট – সেটাও পরিষ্কার করেননি। কিন্তু বেলুচিস্তানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যে ভারত-পাকিস্তানের ৭৮ বছর ব্যাপী শত্রুতার কথাই বলতে চেয়েছেন, তা বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না।   

হুসেইন হাক্কানি শুধু একজন আন্তর্জাতিক স্তরের অ্যাকাডেমিকই নন, তিনি দীর্ঘ চার বছর আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। ফলে কূটনৈতিক ভাষা ও ভঙ্গীও তার আয়ত্ত – আর সেটা ব্যবহার করেই তিনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, আরও একবার ‘শত্রু’ ভারতের চাল বুঝতে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে এবং বেলুচিস্তানের মাটিতে তার মাশুলই পাকিস্তানকে দিতে হয়েছে।

হুসেইন হাক্কানির সেই পোস্ট ও অনুবাদের স্ক্রিনশট

হুসেইন হাক্কানির সেই পোস্ট ও অনুবাদের স্ক্রিনশট

তবে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, নরেন্দ্র মোদি যখন বেলুচিস্তানের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন তখন কিন্তু এই হুসেইন হাক্কানিই এই পদক্ষেপের ‘বিপদ’ সম্পর্কে ভারতকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

তখন হুসেইন হাক্কানির যুক্তি ছিল, ভারত যদি সত্যিই বেলুচিস্তানে সহিংসতায় মদত দিতে যায় তাহলে লস্কর-ই-তৈয়বা বা জইশ-ই-মুহাম্মদের মতো সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। তা ছাড়া, বেলুচিস্তানের সঙ্গে যেহেতু ভারতের সরাসরি সীমান্ত নেই, তাই এ কাজে তাদের ইরান ও আফগানিস্তানের সমর্থন লাগবে – যেটা তারা দিতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।

চীনের অবস্থান, কূলভূষণের ‘স্বীকারোক্তি’

বেলুচিস্তানে পাকিস্তান ছাড়াও যে দেশটির প্রবল অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে, সেটি হলো চীন। এর কারণ, ‘চায়না পাকিস্তানে ইকোনমিক করিডরে’র (সিপেক) একটি প্রান্ত বেলুচিস্তানের উপকূলে গোয়াদর বন্দরেই, আর করিডরের অনেকটা অংশ গিয়েছে বেলুচিস্তানের ভেতরে দিয়েই।

অথচ বেলুচ বিদ্রোহীদের বাধায় আজ পর্যন্ত সেখানে ‘সিপেক’ ঠিকমতো কার্যকরী হতে পারেনি। গত কয়েক বছরে বেলুচিস্তানে অসংখ্য চীনা নাগরিক ও প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, প্রাণও হারিয়েছেন বহু চীনা।

গ্লোবাল টাইমসে সেই প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ

গ্লোবাল টাইমসে সেই প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ

চীন কিন্তু বিশ্বাস করে যে বেলুচিস্তানে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো ভারতের কাছ থেকেই মদত পাচ্ছে।

গত বছর (জানুয়ারি, ২০২৪) চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গ্লোবাল টাইমসে’র এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বেলুচিস্তানে ভারত যে ‘সন্ত্রাসবাদে’ মদত দিচ্ছে তার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে তারা। বেলুচিস্তানে ভারতের ‘ষড়যন্ত্র’ ফাঁস হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করে গ্লোবাল টাইমস।

সেখানে জানানো হয়, ২০২৩-র ডিসেম্বরে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ‘বেলুচ ন্যাশনাল আর্মি’র (বিএনএ) একজন কমান্ডার, সরফরাজ আহমেদ বাঙ্গুলজাই পাকিস্তানি সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করে জানিয়েছিলেন – বেলুচ গোষ্ঠীগুলো আসলে ভারতের ইশারাতেই কাজ করছে। এমন কী, ঠিক তার আগের বছর (২০২২) পাকিস্তানি সেনার হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয়ে একজন জেনারেলসহ ছয়জন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন – সেটাও ভারতের নির্দেশে একটি বেলুচ গোষ্ঠীই করেছিল বলে তিনি জানান, লিখেছে দ্য গ্লোবাল টাইমস।

এছাড়া ২০১৬ সালে বেলুচিস্তানে ধৃত ভারতীয় নাগরিক কূলভূষণ যাদব, যাকে পাকিস্তান ভারতীয় গুপ্তচর বলে দাবি করে থাকে – গ্রেফতারির পর তার দেওয়া জবানবন্দিকেও ভারতের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেছে চীনের ওই সংবাদমাধ্যমটি।

কূলভূষণ যাদব

কূলভূষণ যাদব

ওই স্বীকারোক্তিতে কূলভূষণকে বলতে শোনা যায়, তার দায়িত্ব ছিল ভারতের হয়ে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং কীভাবে পাকিস্তানের স্বার্থে আঘাত হানা যায় তার নকশা তৈরি করা। (ভারত অবশ্য আগাগোড়াই দাবি করে এসেছে কূলভূষণ ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য, যিনি ইরানে ব্যবসার কাজে ছিলেন – এবং তাকে ইরান থেকে অপহরণ করে বেলুচিস্তানে নিয়ে এসে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল)।

পাকিস্তানি সাংবাদিক আলি আব্বাস রামিকে উদ্ধৃত করে গ্লোবাল টাইমস আরও লিখেছে, বিএলএসহ অন্য বেলুচ সংগঠনগুলো যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কাছ থেকে নিয়মিত আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পেয়ে থাকে, পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছে তার অজস্র সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে।

ফলে জাফর এক্সপ্রেস ছিনতাইয়ের দুঃসাহসিক হামলায় আরও একবার যে ভারতের দিকেই আঙুল উঠতে যাচ্ছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। ভারত এই অভিযোগ কীভাবে সামাল দেয়, সেটাই এখন দেখার।