
ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ডামাডোল শেষ হয়েছে। এরইমধ্যে ৩৫ বছর পর গত রবিবার মনোনয়ন ফরম বিক্রির মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (চাকসু) নির্বাচনের কার্যক্রম। কি হবে এ নির্বাচনে? কারা হচ্ছেন ছাত্র প্রতিনিধি? এ আলোচনা ঘুরে-ফিরে আসছে ক্যাম্পাসে। এক্ষেত্রে বারবার সামনে আসছে, ডাকসু ও জাকসুতে ছাত্রশিবিরের একচেটিয়া বিজয়ের বিষয়টি।
এক পক্ষ বলছে, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের জয় চাকসু নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া ৫ আগস্ট পরবর্তী ক্যাম্পাসে তাদের বিভিন্ন সেবামূলক কাজ নির্বাচনে এগিয়ে রাখবে। তবে অন্য সংগঠনগুলোর দাবি, ডাকসু বা জাকসুর প্রভাব চাকসুতে পড়বে না। কেননা এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। কোনো প্রভাব বা সমীকরণ নয়, বরঞ্চ ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ও বর্তমান পরিবেশ পর্যালোচনা করে ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা।
ভোটাররা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও সতর্ক। জাতীয় রাজনীতিতে অন্ধ আনুগত্য থাকলেও ক্যাম্পাসে সেটা সামান্য। তাই ভোটাররা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিগত ইতিহাস দেখেই ভোট দেবেন। তবে ক্যাম্পাসগুলোয় শিবিরফোবিয়া বলতে যেটা ছিল, সেটা ডাকসু ও জাকসুর ফলাফলের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে। এটি তার জন্য ইতিবাচক বলে অনেকে মনে করছেন।
ছাত্র অধিকার পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব ও চাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী রোমান রহমান বলেন, ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের বিজয় ছাত্র রাজনীতির মেরুকরণে নতুন মাত্রা আনতে পারে। নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ থাকলেও শিক্ষার্থীরা যে শিবিরোফোবিয়া থেকে বেরিয়ে আসছে সেটি স্পষ্ট। তবে চবিতে তাদের প্রভাব থাকলেও ডাকসু ও জাকসুর মতো একক সংখ্যাগরিষ্টতা পাবে না। ছাত্র সংসদগুলোয় একক নেতৃত্বের পরিবর্তে যারা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করেছেন, শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়েই একটি ভারসাম্যযুক্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচিত করবেন।
প্রভাব বলতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি শঙ্কা কাজ করছে বলে মনে করেন শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চাকসুর শীর্ষ পদপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের যে আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের, তা আমরা ডাকসু, জাকসুতে দেখতে পাইনি। কারচুপি এবং ভোট বর্জনের ঘটনা ঘটেছে। তাই আমাদের মধ্যেও একটা শঙ্কা বিরাজ করছে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে।
তিনি বলেন, এর অন্যতম কারণ আমরা লক্ষ্যে করেছি জুলাই পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা একটি ছাত্রসংগঠনের অনুরক্ত। যে বৈষম্যহীন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা থেকে আশাহত হয়েছি। সেদিক থেকে ডাকসু ও জাকসুর পর চাকসুতে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা করছি।
ছাত্রদলের আরেক নেতা জালাল আহমেদ বলেন, দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসের চেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা। কোনো প্রভাব বা সমীকরণ নয়, বরঞ্চ চবির ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ও বর্তমান পরিবেশ পর্যালোচনা করে শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলকে চাকসুতে অধীর আগ্রহ নিয়ে ভোট দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের আশঙ্কা রয়েছে।
ছাত্রদলের আরেক নেতা মো. শাফায়াত বলেন, ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের একচেটিয়া জয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর প্রভাব চাকসুতে পড়বে বলে মনে হচ্ছে না, কারণ এখানকার পরিবেশ ভিন্ন। জাকসুতে স্বতন্ত্র ভিপির জয় একটি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে, বিকল্পও সম্ভব। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে প্রশাসনের অনিয়ম, কেন্দ্র দখল, প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছিল। সে আশঙ্কা চাকসুতেও আছে। চাকসুতে শিক্ষার্থীরা চায় খোলামেলা, শান্তিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন, যেখানে সবার আস্থা থাকবে এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।
ডাকসু বা জাকসুর ফলাফল চাকসুর নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন ইসলামী ছাত্র মজলিসের শাখা সভাপতি ও চাকসুর ভিপি পদপ্রার্থী সাকিব মাহমুদ রুমিও। তিনি বলেন, চবির ইতিহাস ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাম্পাসের পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে কারা রক্ত ঝরিয়েছে, খুন, গুমে জড়িত ছিল, কী কী করেছে– এসবকিছু বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।’
ইসলামি ছাত্র আন্দোলনের শাখা সভাপতি ও চাকসুর জিএস পদপ্রার্থী আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট জ্ঞানী এবং তারা দেশ জাতি ও নিজেদের কল্যাণ নিয়ে ভাবতে পারেন। তাই তারা জোয়ারে গাঁ ভাসাবেন না। শিক্ষার্থীরা যাকে ভালো মনে করেন, তাকে ভোট দেবেন, তা যে কেউ হতে পারে। চাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ একক প্যানেল নিয়ে আগাচ্ছে, দুই-এক দিনের মধ্যে আমাদের প্যানেল ঘোষণা করব। আমরা একটি ইনক্লুসিভ প্যানেল দেওয়ার চেষ্টা করছি, সংগঠনের বাহিরেও যোগ্য প্রার্থীদের সংযুক্ত করছি।’
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহবায়ক ও সম্ভাব্য ভিপি প্রার্থী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি শিক্ষার্থীরা তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম দেখবে।’
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ডাকসু ও জাকসুতে শিক্ষার্থীরা সেখানকার শিবিরের কার্যক্রম দেখেই তাঁদের যোগ্য মনে করে নির্বাচিত করেছেন। সেখানকার প্রভাব না, বরং আমরা মনে করি, যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ হাজার শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করেছে, শিক্ষার্থীরা সেটাই মূল্যায়ণ করবেন। যোগ্য প্রার্থীকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন তারা।’
গত রবিবার থেকে শুরু হয়েছে মনোনয়ন ফরম বিতরণ। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও হল সংসদে শতাধিক করে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। আজ মঙ্গলভার ফরম বিতরণের শেষ দিন। এখনও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেনি ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার, বাম সংগঠনের একাংশ, ছাত্রদলের একাংশের প্রার্থীসহ অনেকে। ধারণা করা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদ মিলিয়ে এক হাজারের কাছাকাছি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হবে।
নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব কে এম আরিফুল হক সিদ্দিকী বলেন, ‘গত দুই দিন শিক্ষার্থীরা মোটামুটি মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। আজ শেষ দিনে আশা করছি সবাই নেবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অন্যরকম উন্মাদনা দেখেছি।’
ছাত্রদল ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেলে নজর সবার
চাকসু নির্বাচনে এ পর্যন্ত আটটি সম্ভাব্য প্যানেলের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এরমধ্যে ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্র মজলিস, ইসলামি ছাত্র আন্দোলন, বামদের সমন্বিত জোট, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আলাদা দুটি প্যানেল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সবাই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেলের জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন বলে জানিয়েছে সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা।
অন্যদিকে ছাত্রদল একক প্যানেলের চিন্তা করছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটির একাধিক নেতা। চাকসু নির্বাচনে সংগঠনটির কারা শীর্ষ পদে আসবেন এ নিয়ে চলছে আলোচনা। বড় সংগঠন হওয়ায় অনেকে শীর্ষ পদের দাবিদার। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুতই প্যানেল ঘোষণার কথা জানানো হয়েছে।
ডোপ টেস্ট পজিটিভ হলে প্রার্থিতা বাতিল
মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার সময় প্রার্থীকে ডোপ টেস্ট করার জন্য একটি কার্ড প্রদান করবে নির্বাচন কমিশন। পরে প্রার্থী কার্ডটি নিয়ে ৩৫০ টাকা ফি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে ডোপ টেস্টের নমুনা দিয়ে আসবেন। মনোনয়নপত্র নেওয়ার সময় অনলাইনে চূড়ান্ত ভোটার তালিকার প্রমাণ আর শিক্ষার্থীর ভোটার আইডি নম্বর দিতে হবে।
এরপর পরিচয়পত্র দেখিয়ে মনোনয়নপত্র নেওয়া যাবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রার্থীকে তাঁর পরিচয়পত্র, ছবি এবং ডোপ টেস্টের ফলাফল দিতে হবে। টেস্ট পজিটিভ হলে প্রার্থিতা বাতিল করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।