
দেশে উচ্চশিক্ষালয়ের মানের তুলনায় সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে যখন চতুর্মহলে প্রশ্ন উঠছে, ঠিক তখনই চালুর অপেক্ষায় আরও ছয়টি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম। আবার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হলেও একাডেমকি কার্যাবলী শুরুর তালিকায় রয়েছে আরও দুই প্রতিষ্ঠান।
উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে কোনো পথরেখা জানা যায়নি। তবে উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া এসব বিশ্ববিদ্যালয় যেকোনো সময়ে পুরোদমে চালু হতে পারে।
উচ্চশিক্ষা খাতে ‘সংখ্যায় বৃদ্ধি’ কেন্দ্রিক এ প্রবণতা নিয়ে শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ। তারা বলছেন, গবেষণায় পশ্চাৎপদতা এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত উৎকর্ষের অভাব যখন স্পষ্ট, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চালুর অপেক্ষায় রাখার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।
দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৬টি। অনুমোদন (আইন) হয়েছে আরও পাঁচটির। এর মধ্যে ২০১৩ সাল ও তার পর থেকে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়। যার অধিকাংশই কৃষি, মেডিকেল, ডিজিটাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৬টি।
চালুর অপেক্ষায় থাকা নতুন আট বিশ্ববিদ্যালয় হলো— নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়, মেহেরপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়; লক্ষীপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; সাতক্ষীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নারায়ণগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এরমধ্যে গত ৭ অক্টোবর নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ২ ডিসেম্বর মেহেরপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে ভিসি নিয়োগ হওয়ায় চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন পাস হয়েছে ২০২৩ সালে। তবে ভিসি নিয়োগ না হওয়ায় ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। খুব দ্রুত ভিসি নিয়োগের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরে একটি সূত্র।
তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালাতে পারলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক, গবেষণা অনুদান, মানসম্মত পাঠক্রম, আধুনিক ল্যাবরেটরি ও একাডেমিক পরিকাঠামোর অভাবে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সক্ষমতা এখনো গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণায় বরাদ্দ বাজেট ১ শতাংশের নিচে। এমন বাস্তবতায় আরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদরা।
তাদের মতে, বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত না করে নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করা হলে তা উচ্চশিক্ষার সংকট আরও ঘনীভূত করতে পারে। অ্যাকাডেমিক ভবন, গবেষণাগার, শ্রেণিকক্ষ নির্মাণসহ সামগ্রিক কাজ সম্পন্ন করার পরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া উচিত।
বিদ্যমান অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়া করা কক্ষে পাঠদান দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার পরিবেশ পাচ্ছে না। হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যদের তেমন গবেষণাও নেই। এ অবস্থায় সরকারের উচিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন কিংবা ভিসি নিয়োগ না দিয়ে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে কাজ করা। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলে কেবল সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদতে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রয়োজনীয়তা নেই।’-ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইউজিসি বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ভূমিকা থাকে। বিগত সরকারের আমলে সেই প্রভাবেই অপরিকল্পিতভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। যদিও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হলে কিছু করার থাকে না বলছে ইউজিসি। অনেকটা বাধ্য হয়েই আইন তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয় তাঁদের।
এ বিষয়ে ইউজিসি পরিচালক (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) জামিনুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের পূর্বে আমরা সরেজমিনে সবকিছু পরিদর্শন করে থাকি। পরবর্তীতে একটি রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয় কি না সেটি কমিশনের নীতি নির্ধারকরা বলতে পারবেন।’
ইউজিসি জানিয়েছে, দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৬টি। অনুমোদন (আইন) হয়েছে আরও পাঁচটির। এর মধ্যে ২০১৩ সাল ও তার পর থেকে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়। যার অধিকাংশই কৃষি, মেডিকেল, ডিজিটাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৬টি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ার পর ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের নামে বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা ও মানসম্পন্ন পাঠদান অগ্রাধিকারে থাকে না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনোটিতে ভূমি অধিগ্রহণেও অনিয়মের অভিযোগ উঠছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিষ্ঠার সাত বছরের মধ্যে নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে হয়। আবার নিজস্ব ক্যাম্পাসের আগে বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর জন্য ন্যূনতম ২৫ হাজার বর্গফুটের ভাড়া বা নিজস্ব জায়গা থাকতে হয়। ইউজিসি স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বারবার তাগাদা দেয়। নিজস্ব ক্যাম্পাসে না যেতে পারলে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে। এ কারণে পুরনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে গেছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো নিয়ম নেই। তবে পাবলিকের ক্ষেত্রেও এ ধরনের কড়াকড়ি আরোপ কর দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তারও জবাব মেলেনি। সংস্থাটির পাবলিক ইউনিভার্সিটি বিভাগের সদস্য অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানও ব্যস্ত আছেন জানিয়ে তাৎক্ষণিক কোনও মন্তব্য করেননি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আবরারও ফোনকল রিসিভ করেননি।
সমাধান কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালুর আগে দরকার একটি জাতীয় নীতিগত পর্যালোচনা। শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যুগোপযোগী পাঠক্রম, পর্যাপ্ত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক, গবেষণা অনুদান এবং স্বাধীন একাডেমিক পরিবেশ প্রয়োজন।
তারা বলছেন, সংখ্যার পেছনে না ছুটে এখন সময় মানের দিকে নজর দেওয়ার। উচ্চশিক্ষাকে শুধু ডিগ্রি বিতরণকারী ব্যবস্থায় পরিণত করা হলে তা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক হবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি—এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিদ্যমান অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়া করা কক্ষে পাঠদান দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার পরিবেশ পাচ্ছে না। হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যদের তেমন গবেষণাও নেই। এ অবস্থায় সরকারের উচিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন কিংবা ভিসি নিয়োগ না দিয়ে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে কাজ করা। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলে কেবল সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদতে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রয়োজনীয়তা নেই।’