
ইরানের একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শনিবার রাতে ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলের শহর বাট ইয়ামের একটি আবাসিক ভবনে আঘাত হানলে অন্তত সাতজন নিহত হন। আহত হন আরও শতাধিক ব্যক্তি। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন তিনজন।
এটা ছিল ইরানের টানা দ্বিতীয় রাতের মতো ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে সাইরেন বেজে ওঠে। স্থানীয় সময় রাত আড়াইটার পরপর তেল আবিব, দেশের মধ্যাঞ্চলের অনেক এলাকা, আশদোদ শহর এবং জেরুজালেমের অনেক এলাকার বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে যান। পরে বাট ইয়াম শহর ছাড়াও রেহোভোট ও রামাত গানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়।
বাট ইয়ামে নিহত সাতজনের মধ্যে আট বছরের একটি মেয়ে, ১০ বছরের একটি ছেলে এবং ১৮ বছরের এক তরুণ রয়েছে। সেখানে প্রায় ২০০ ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে উদ্ধাকর্মীরা জানিয়েছেন।
সাতজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) হোম ফ্রন্ট কমান্ডের সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ ব্রিগেডের সেনারা রোববার সকালেও ধ্বংসস্তূপে তাঁদের সন্ধান চালান বলে দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে।
এ এলাকার বাসিন্দা রিবাট ভাকনিন চ্যানেল ১২ নিউজকে বলেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি সময়মতো নিরাপদ আশ্রয়ে (বোম্ব শেল্টার) যেতে পারেননি।
‘আমার ভাই তাঁকে আনতে ঘরে ঢুকেছিল। তখন বিস্ফোরণ ঘটে। ভয়ানকভাবে সবকিছু কাঁপতে থাকে। আমার ভাই আহত হয়েছে, আমার কুকুর আহত হয়েছে। তারা এখন আমার বাবাকে খুঁজছে,’ বলেন তিনি।
গিমেল নামের ৫০ বছর বয়সী এক নারী জানান, তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে ‘জোয়া’ নামে তাঁর কুকুরের খোঁজ করছেন। তিনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেটকে বলেন, ‘আমি একা বাড়িতে ছিলাম। আমি সাইরেনের শব্দ শুনি এবং বোম্ব শেল্টারে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু প্রথমে দৌড়ে বাথরুমে যাই। আমি দুটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনি, ভেবেছিলাম এটা শেষ হয়েছে। পরে যখন শুনলাম উত্তর দিকে চার নারী নিহত হয়েছেন, তখনই হঠাৎ আমার মাথার ওপর সবকিছু ভেঙে পড়ল। পুরো ছাদ ধসে পড়ল।’
ওই নারী বলেন, ‘আমি নিজেকে বলছিলাম, আমি মারা যাচ্ছি।’
গিমেল বলেন, তিনি নিচে নিরাপদ আশ্রয়কক্ষের দিকে যান, যেটা বন্ধ ছিল। কিন্তু তখন রক্তে ভাসতে থাকা একজন প্রতিবেশীকে দেখেন। তিনি বলেন, ‘আমি তখন আমার মা–বাবার কথা ভাবছিলাম, যাঁরা বোম্ব শেল্টারে যেতে পারেন না। আপনার মনে হবে, আপনাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে।’
পাশের সড়কের বাসিন্দা বারুচ বলেন, ‘আমি আমার জীবনে এমন কিছু দেখিনি।’ তিনি বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করেছি। ছয় দিনের যুদ্ধের সময় গোলান মালভূমিতে আমি লড়াই করেছিলাম। কিন্তু সেখানে এমন কিছু ঘটেনি।...বোমার শক্তি দেখে আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম।’
বাট ইয়ামের মেয়র টিভিকা ব্রোট এক বিবৃতিতে বলেছেন, শনিবার রাতের হামলায় ৬১টি ভবন কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছয়টি ভবন পুরোপুরি ধ্বংস করতে হবে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রেহোভোটে অন্তত ৪২ জন আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২ জন গুরুতর আহত এবং ১৩ জন মোটামুটি আহত হয়েছেন বলে দেশটির জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা সংস্থা মেগান ডেভিড আদম (এমডিএ) জানিয়েছে। সেখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে উদ্ধারকর্মীরা বের করে আনার আগপর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন।
ইউনাইটেড হাটজালাহ রেসকিউ সার্ভিসেসের স্বাস্থ্যকর্মী গোলান লেভি ওয়ালা নিউজ সাইটকে বলেছেন, এ এলাকার একটি ভবনে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দেড় বছরের এক শিশু ও তার মা রয়েছেন।
গোলান বলেন, অনেকের হাত-পা ভেঙে গেছে, কারও রক্ত ঝরছে। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত, ভয়ে চিৎকার করছিলেন। এই এলাকা পুরোনো হওয়ায় এখানকার বেশির ভাগ বাড়িতে বোম্ব শেল্টার নেই। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রভাবে এলাকার বাড়িগুলো ধসে পড়েছে। এলাকার বাসিন্দারা পৌর মার্কেটের সামনে মেঝেতে শুয়ে ছিলেন এবং উদ্ধারকর্মীদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কয়েকজনকে কাছের একটি বোম্ব শেল্টার থেকে উদ্ধার করা হয়।
রেহোভোটের ওয়াইজমান ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্সের একটি ভবনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে গবেষণাগার থাকা অন্তত একটি ভবনে আগুন ধরার কথা বলা হয়েছে। সেখানে এর ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে।
শনিবার রাতে হাইফার পূর্বের তামারা শহরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় চারজন নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী নাগরিকদের প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার স্থান ও ফুটেজ প্রকাশ না করতে আহ্বান জানিয়েছে। শত্রুরা তাদের হামলার সক্ষমতা বাড়াতে এসব ফুটেজ দেখে বলে সতর্ক করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
ইরান ও ইসরায়েলের এ সংঘাত শুরু হয় গত শুক্রবার ভোররাতে ইসরায়েল ইরানে নজিরবিহীন হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে। সেদিন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাঁটিতে হামলার পাশাপাশি ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে ইসরায়েল।