Image description

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি (এজিএস) পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভেতরে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

সংগঠনের সিদ্ধান্ত অমান্য করে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের এক নেতার অনুসারী শাখাওয়াত হোসাইন শিপন এই পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর ফলে শিবিরের ভোটভিত্তি বিভক্ত হয়ে যায়, এবং শেষ পর্যন্ত ওই পদটি জয় করে নেয় ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী।

শিবিরের নির্ধারিত প্রার্থী ছিলেন সাজ্জাদ হোসেন মুন্না। সংগঠনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শাখাওয়াতকে প্রার্থী করা হয়নি। কিন্তু তিনি কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করে মনোনয়নপত্র জমা দেন এবং প্রচারণাও চালান নিজস্ব গোষ্ঠীভিত্তিক সমর্থন নিয়ে।

নির্বাচনে ফলাফলে দেখা যায়, ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক ৭ হাজার ১৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। শিবির সমর্থিত প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন মুন্না পান ৫ হাজার ৪৫টি ভোট। আর বিদ্রোহী প্রার্থী শাখাওয়াত হোসাইন পান ৫৩৫টি ভোট। এই ভোটগুলো যদি শিবিরের নির্ধারিত প্রার্থীর পক্ষে যেত, তাহলে ফলাফল ঘুরে যেতে পারতো বলে মনে করছেন সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী।

'আমি শিবিরের কেউ নই’ শাখাওয়াতের ব্যাখ্যা

এই বিষয়ে শাখাওয়াত হোসেন আমার দেশকে বলেন, আগে সংগঠন বা শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এখন শিবিরের কেউ না। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলাম

নির্বাচনের পর আজ বৃহস্পতিবার নিজের ফেসবুক পেজে দীর্ঘ এক পোস্টে শাখাওয়াত লেখেন, আমি জুলাই মাসে ছাত্রশিবির থেকে অফিশিয়ালি বিদায় নিয়েছি। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে ছাত্রশিবির থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা দেয়নি তাতেও কোনো আপত্তি করিনি। কিন্তু ফরম তোলার পর থেকেই আমি বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি। তিনি দাবি করেন, শিবিরের নেতারা শুধু তাকে নয়, এমনকি তার সমর্থক ও বন্ধুদেরও ব্যক্তিগতভাবে হয়রানি করেছেন।

‘আমার যেসব বন্ধু আমার পোস্টে লাইক বা কমেন্ট করেছেন, তাদেরকেও শিবিরের সভাপতি ফোন দিয়ে নোটিশ দিয়েছেন। আমার বক্তব্য যেন মিডিয়ায় না যায়, সেজন্যও কিছু মহল থেকে ষড়যন্ত্র হয়েছে,' লেখেন শাখাওয়াত।

শিবিরের এক সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটি ছিল সম্পূর্ণভাবে ওই নেতার গ্রুপের উসকানিতে ঘটানো বিদ্রোহ। সংগঠনের ভাবমূর্তি ও ঐক্য নষ্ট করার জন্যই এমন করা হয়েছে। এর দায় শুধু শাখাওয়াত নয়, যারা তাকে প্ররোচনা দিয়েছে, তাদেরও।

তিনি আরও বলেন, শিবিরের মূল সমর্থকরা দ্বিধায় পড়েছিলেন, কাকে ভোট দেবেন। অনেকে ভোট দেননি, কেউ কেউ আবার বিভ্রান্ত হয়ে ভুল প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। এর ফলেই এজিএস পদটি হারাতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নতুন নয়। কিন্তু এই বিদ্রোহী প্রার্থিতার ঘটনাটি এবার সরাসরি ভোটের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচনে দাঁড়ানোর কারণে আমাদের এজিএস প্রার্থী পরাজিত হয়েছে, বিষয়টি আমরা সঠিক মনে করি না। শিক্ষার্থীরা যাকে পছন্দ করেছে, তাকেই ভোট দিয়েছে। আর সাখাওয়াত হোসেন ছাত্রশিবির থেকে বিদায় নিয়েছে। সেই তার ব্যক্তিগত অধিকার থেকে নির্বাচন করেছে।

বিদ্রোহী প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন, সেগুলো সঠিক নয়।

একজন নিরপেক্ষ শিক্ষক মন্তব্য করেন, যখন কোনো আদর্শিক সংগঠনের অভ্যন্তরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রবেশ করে, তখন এই ধরনের বিভাজন ঘটে। জামায়াত নেতা অনুসারীদের মধ্যে এখনো অনেকে মনে করেন, সংগঠনকে তাদের ইচ্ছামতো চালানো উচিত। কিন্তু সেটাই শিবিরের জন্য বড় বিপদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে শিবির একসময় একক প্রভাবশালী সংগঠন ছিল। কিন্তু গত বছর শেখ হাসিনা পালানোর পর গোষ্ঠীগত বিভাজন, কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং জামায়াত রাজনীতির দিকনির্দেশনা নিয়ে মতবিরোধ তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে দুর্বল করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচন তারই প্রতিফলন যেখানে আদর্শ নয়, গোষ্ঠীগত আনুগত্য জয়-পরাজয়ের নির্ধারক হয়ে উঠেছে।

জামায়াত নেতার ছায়া রাজনীতি

শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মনে করছে, শাখাওয়াতের এই বিদ্রোহ কেবল ব্যক্তিগত অসন্তোষের ফল নয় এর পেছনে কাজ করছে জামায়াতের এক প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যারা দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে টানাপোড়েনে রয়েছে। মহানগর জামায়াতের সাবেক এই নেতার এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। তার অনুসারীরা শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, শহরের রাজনীতিতেও সমান্তরাল প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

চবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা এজিএস পদে দাঁড়িয়েছে বলে ছাত্রশিবির মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হয়েছে, বিষয়টি এভাবে বলার সুযোগ নেই। কেননা ওই সাবেক নেতা যত ভোট পেয়েছেন, সেটা যোগ করলেও শিবিরের মনোনীত প্রার্থী জয়ী হতে পারতেন না। নির্বাচনে মূলত অনেকগুলো বিষয় ফ্যাক্টরি হিসেবে কাজ করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- ব্যক্তিগত গুণাবলী, গ্রহণযোগ্যতা ও বাগ্মীতা। এসবে বিজয়ী প্রার্থী এগিয়ে গিয়েছেন।

তবে আরেক শিক্ষক (নাম প্রকাশ করেনি) বলেন, চবি শিবিরে এখন দুই মেরু স্পষ্ট একদিকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুসারী, অন্যদিকে ওই নেতার ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী। চাকসু নির্বাচন সেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। ওই শিক্ষকের মতে, এই বিভক্তি শুধু নির্বাচনেই নয়, ক্যাম্পাসের সাংগঠনিক কৌশল, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও নতুন সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও ওই জামায়াত নেতার বিভক্তমূলক রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন অভিযোগ রয়েছে।

জামায়াতের একাধিক সূত্র বলছে, তিনি চট্টগ্রাম মহানগর এবং নিজের রাজনৈতিক ঘাঁটিতে বা এলাকাতেও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা থেকে ভিন্ন পথে সংগঠন পরিচালনা করেন। এই অবস্থানকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জামায়াত ও শিবিরে নেতৃত্ব সংকট তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতেও ছায়া ফেলেছে।