
৫ আগস্টের পর দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক নেতৃত্বে বড় ধরনের রদবদল হয়। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভিসি ও প্রোভিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে নতুন নেতৃত্ব আসে- ভিসি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: শামসুল আলম, আর প্রোভিসি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু জাফর খান।
নতুন প্রশাসন এক বছর ধরে বিগত দশকের স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও দলীয়করণের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে নিয়োগবাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতি গ্রহণের ফলে বহু দিনের অব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অচল করে দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে ইউজিসিতে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) ঘাপটি মেরে থাকা কিছু ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী ও বিগত ফ্যাসিস্ট আমলের দোসররা তদন্তের নামে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করছে।
তদন্ত কমিটি ও টিওআর পরিবর্তন : ইউজিসি থেকে বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে সংঘটিত দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তের জন্য প্রথমে সদস্য সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। অতি সম্প্রতি তা বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকারকে প্রধান করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে কমিটির টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) পরিবর্তন করে শুধু অতীত নয়, বর্তমান প্রশাসনের নিয়োগপ্রক্রিয়াও তদন্তের আওতায় আনা হয়; যা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের অভিযোগ, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে বেআইনিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে আগের তদন্তের সুপারিশ তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না; বরং নতুন নিয়োগ স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয়কে পঙ্গু করতে চাইছেন।’
অভিযোগের আরেকটি দিক হলো কমিটির প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম সরকার এবং আইবিএর অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের জন্য পরিচিত; যা বর্তমান প্রশাসন ও শিক্ষকমহলের একাংশের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক প্রভাব : ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের লক্ষাধিক মাদরাসা শিক্ষার্থী ও আলেম উলামার দীর্ঘ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু একসময় এরশাদের ঘনিষ্ঠ, পরে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ, আর এখন বিএনপির সাথে সম্পর্কিত একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অনুষ্ঠানগুলোতে বিএনপির নেতাদের আমন্ত্রণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনা এ অভিযোগকে ঘনীভূত করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, নতুন প্রশাসন আসার পর নিয়োগবাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা ও তাদের সহযোগীরা পুনর্দখলের চেষ্টা করছে এবং ইউজিসিতে থাকা কিছু প্রভাবশালী সদস্যের সাথে মিলে নতুন প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষণ : স্বচ্ছতা বনাম ‘রাজনৈতিক টানাপড়েন’
শিক্ষাবিদদের মতে, ইউজিসির কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা ও অনিয়ম দূর করা। তবে এ ধরনের তদন্ত যদি রাজনৈতিক অভিসন্ধি বা আদর্শিক পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে প্রভাবিত হয়, তাহলে সেটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে।
একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও গত এক দশকের দুর্নীতি ও দলীয়করণের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরি; যাতে নতুন প্রশাসনের বৈধতা মজবুত হয় এবং প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত অর্থেই সংস্কারপন্থী ধারায় স্থিত হয়।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এখন এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে। নতুন নেতৃত্ব ফ্যাসিস্ট আমলের অনিয়ম দূর করে স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া চালু করতে চাইছে, আর আগের নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠীগুলো সেই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে- এই দুই শক্তির সংঘর্ষের মধ্যেই ইউজিসির তদন্তের রাজনৈতিক ও নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হবে। দেশের আলেম উলামা ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রতিফলন হিসেবে গড়ে ওঠা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষার পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করাও সমান জরুরি বলে করছেন সংশ্লিষ্টরা।