
ছয় দশক!
এই দীর্ঘ সময়জুড়ে একটানা আলোয় থাকা, গানে গানে জয় করা কোটি শ্রোতার হৃদয়—এ এক অনন্য কীর্তি। এই কীর্তির নাম রুনা লায়লা। উর্দু, হিন্দি, বাংলা—তিন ভাষাতেই সমান পারদর্শী এই শিল্পী আজ উপমহাদেশের সংগীত ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তি। কিন্তু এই আলোকিত পথচলার শুরুটা ছিল না সহজ। ১৯৭০-এর দশকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসেই তাঁকে পড়তে হয়েছিল নানা বাধা, ঈর্ষা আর বয়কটের মুখে। তবু সব প্রতিকূলতার মাঝেও গানই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন, আশ্রয় আর শক্তি।
নাচের সেই মেয়েটি
সংগীতশিল্পী হিসেবেই পরিচিতি রুনা লায়লার। তবে তাঁর শুরুটা হয়েছিল নাচ দিয়ে। নাচ তাঁর পছন্দ ছিল। ছোট্ট রুনা লায়লার লম্বা সময় কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। বাবা এমদাদ আলী ছিলেন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। সেখানে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে মেয়েকে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করেন মা আমিনা লায়লা। এই প্রতিষ্ঠানে চার বছর নাচ শিখেছেন রুনা। শিক্ষক ছিলেন আফরোজা বুলবুল। রুনা তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন কত্থক আর ভরতনাট্যম। রুনা বলেন, ‘এখন আর সেসব মনে নেই। তবে মঞ্চে যখন গান করি, নিজের অজান্তেই তখন নাচের কিছু মুদ্রা চলে আসে।’
ছোটবেলায় নানি সব ভাইবোনকে টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকায় একেকজন একেক জিনিস কিনলেও নিজের টাকায় এক জোড়া ঘুঙুর কেনেন রুনা। এই ঘুঙুর পরে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াতেন আর নাচতেন। নাচটা যে তাঁর খুব পছন্দের, মা জানতেন। তখন তিনি বলেন, ‘তোমার যেহেতু নাচের এতই শখ, একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিই।’ পরে চার বছর নাচ শিখেছেন রুনা। একাডেমির হয়ে অনেক পরিবেশনায়ও অংশ নেন।
পরে যে রুনা লায়লা বাঙালির অন্যতম প্রিয় সংগীতশিল্পী হয়ে উঠবেন, সেই রুনা কেবল নাচ নিয়ে থাকবেন; তা কি হয়! ভাগ্যই তাঁকে গানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। বড় বোন দিনা লায়লা গানের তালিম নিতেন আবদুল কাদের, হাবিব উদ্দিন আহমেদের কাছে। পাশের ঘরে ঘুরে বেড়ানো রুনা তখন দৌড়াদৌড়ি করতে করতে বোন যা গাইতেন, তা-ই মুখস্থ করে ফেলতেন। পরে তিনিও গাইতেন। একদিন ওস্তাদ আবদুল কাদের রুনার গাওয়া গান শুনে ফেলেন। মুগ্ধ হন। বিস্মিতও হন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, একদিন রুনা লায়লা গানে অনেক সুনাম কুড়াবে। ওস্তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে। নাচের তালিম নেওয়া রুনা লায়লা হয়ে ওঠেন বাংলা গানের মহাতারকা।
পাকিস্তান অধ্যায়
বাবার চাকরির সূত্রে ছোটবেলা কেটেছিল পাকিস্তানে। সেখানে পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা এবং সংগীতজীবনের শুরু। ১৯৬৪ সালের ২৪ জুন। করাচির ইস্টার্ন স্টুডিওতে প্রথম গান রেকর্ড করেন রুনা। পরের বছর ১৯৬৫ সালে ‘জুগনু’ ছবির সেই গান মুক্তি পায়। তখন রুনার বয়স ১২। বললেন, ‘লাহোর থেকে একটি ছবিতে গান করার প্রস্তাব আসে। আব্বা শুনেই না করেন। গান গাওয়া নিয়ে আব্বার কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তখন অনেকেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। আমার খুব ইচ্ছা হলো। তখন সব বড় শিল্পী রেডিওতে গান করতেন। ভাবতাম, একদিন রেডিওতে আমার নামও বলবে। সবাই আমার গান শুনবে। বাবাকে আমার ইচ্ছার কথা জানান মা। অনেক কষ্ট করে তিনি আব্বাকে রাজি করালেন। আমি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম।’ উর্দু ছবির গানটির শিরোনাম ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। সুরকার মাসরুর আনোয়ার, সফদার হুসাইনদের মতো বরেণ্য শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন খুব অল্প বয়সেই। কিশোরী কণ্ঠেই ঝরে পড়ে পরিণত গায়কির সুর। ধীরে ধীরে পাকিস্তানের সংগীতজগতে রুনা হয়ে ওঠেন পরিচিত নাম। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে ভারতেও। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রভাবশালী গায়িকা নূরজাহানের পর যদি কারও নাম আলোচনায় উঠে আসত, তিনি রুনা লায়লা।

বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ও বয়কট রুনা
রুনা লায়লা দেশে–বিদেশে উজ্জ্বল করেছেন বাংলাদেশের নাম। দেশের শিল্পীদের পাশাপাশি উপমহাদেশীয় সংগীতের বরেণ্য শিল্পীদের সঙ্গে রয়েছে তাঁর চমৎকার বন্ধুত্ব। বয়সে ছোট যাঁরা, তাঁদের অনেকে এই শিল্পীকে মানেন আদর্শ। অথচ দেশের সংগীতের বরেণ্য এই শিল্পীকে সত্তরের দশকে একবার বয়কট করা হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে মঞ্চে এবং একসঙ্গে কোনো গান গাইতে চাননি সমসাময়িক শিল্পীদের অনেকে। তবে
এ নিয়ে মোটেও বিচলিত ছিলেন না রুনা লায়লা। আপন মনে তিনি গান গেয়ে গেছেন। রুনার মতে, ‘সবাই দেখল, আমি ছবিতে গান করছি, কেউ বয়কট মানছে না। মিউজিশিয়ানরাও বাজাচ্ছে। মিউজিক ডিরেক্টররাও কাজ করছে। সত্যি বলতে, শ্রোতার ভালোবাসায় সেই বয়কটও টেকেনি।’ প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে তেমনটাই জানান উপমহাদেশীয় সংগীতের বরেণ্য এই শিল্পী।

জীবনের প্রথম দিক পাকিস্তানে কেটেছে রুনা লায়লার। গানে গানে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন দেশটিতে। বাবার চাকরির সূত্রে তিনি সেখানে ছিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর অনেকে তাঁকে শুভকামনা জানালেও কেউ কেউ রুনা লায়লার সাফল্যে ঈর্ষান্বিতও ছিলেন। তাই বারবার বাধার মুখে পড়েছিলেন তিনি। কীভাবে এসব বাধা কাটিয়ে উঠেছেন, এমন প্রশ্নে রুনা লায়লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবন মানে ইতিবাচকভাবে সবকিছু দেখা। নিজে ইতিবাচক থাকলে সবকিছুই ঠিক। মনের জোর থাকতে হয়। মনের জোর থাকলে অনেক বাধা অতিক্রম করা যায়। আমার জীবন হচ্ছে, আমার গান ও পরিবার। পরিবার নিয়েই আমার জীবনটা। একটা কথা হচ্ছে, বাধা অনেক এসেছে জীবনে; কিন্তু আমাকে কারও কাছে কোনো দিন যেচে কাজ চাইতে হয়নি। আমাকে দিয়ে গান গাওয়াও—এটা বলতে হয়নি। আল্লাহর রহমতে সবাই আমার নিজের কাছেই এসেছে গানের প্রস্তাব নিয়ে। বাধা এলে ওপরওয়ালা বিচার করেন, তিনি একজন তো আছেন, সব দেখেন।’
কথা প্রসঙ্গে রুনা লায়লা বলেন, ‘আমি কিন্তু কখনোই ভেঙে পড়িনি। ওপরওয়ালার ওপরে অনেক বেশি বিশ্বাস ছিল। সব সময় ভেবেছি, আমার মধ্যে যদি ট্যালেন্ট থাকে, সব বাধা অতিক্রম করব। আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এটা কোনোভাবে আমাকে মন খারাপ বা হতাশায় পড়তে দেয়নি। সবচেয়ে বড় বিষয়, আমার পরিবারের সদস্যরা সব সময় পাশে ছিল।’
গান দিয়েই সব মোকাবিলা
গানে গানে শ্রোতার ভালোবাসা যেমন রুনা লায়লা পেয়েছেন, তেমনি এই অঙ্গনের ভেতরকার নোংরা রাজনীতির খবরও তাঁর নজর এড়ায়নি। তবে গান দিয়েই সব মোকাবিলা করতে চেয়েছেন। আজ পর্যন্ত সেটাই করে চলছেন বলে জানালেন এই কিংবদন্তি।
রুনা লায়লা বলেন, ‘আমি যে নানাভাবে বাধার মুখোমুখি হয়েছি, এসব নিয়ে তখন অনেক লেখালেখি হয়েছে। তাই আমার গান সম্পর্কে যেমন শ্রোতারা জানত, তেমনি আমার সঙ্গে যা ঘটছে, সেসবও তারা জানত। আমার পরিবারও জানত। এত বেশি লেখালেখি হয়েছিল যে আমার কাউকে বলতেও হতো না। আমার সঙ্গে কেন এমনটা হচ্ছে, সেটাও ভক্তদের বুঝতে সমস্যা হয়নি। আর এসব নেতিবাচক বিষয়ে আমি উত্তেজিত হয়েছি বা ভয় পেয়ে গেছি, তেমনটা কখনো ঘটেনি। যারা আমাকে নিয়ে নেগেটিভিটি ছড়াচ্ছে, তাদের ভুল একদিন ভাঙবে, এমন বিশ্বাস ছিল। সব সময় ভেবেছি, আল্লাহ তাআলা সব দেখছেন, ভালো করলেও সেটার বিচার পৃথিবীতে পাওয়া যায়, খারাপ করলেও হয়। তাই মন থেকে কখনো কাউকে বদদোয়া দিইনি, দেবও না। সব সময় যারা আমার বিপক্ষে গেছে, তাদের সম্পর্কে ভালোই বলেছি। আমি আমার মতো গান নিয়ে আছি, পরিবার নিয়ে হ্যাপি আছি। তাই কে কী বলল, তা নিয়ে আমার কিছু যায়–আসে না। পরোয়াও করি না। আমি সব সময় সোজা পথে চলেছি। কারও ক্ষতি করিনি, করার ইচ্ছাও ছিল না, নেইও। কোনো দিন হবে না। যতটা পারব মানুষের উপকার করব, সে যতটা আমার সঙ্গে খারাপ করুক। প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা কোনো দিন জাগেনি, জাগবেও না। আমি সে ধরনের মানুষও নই।’
রুনা লায়লা এই শিক্ষা তাঁর পরিবার থেকে পেয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানান। তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, তখন মা-বাবার কাছ থেকেই আসল শিক্ষাটা নেয়। কোন পথে চলতে হবে, কোন পথ সহজ, কোনটা বাঁকা, এটা তাঁরাই শিখিয়ে দেন। তাঁদের শেখানো পথেই আমরা বড় হই। আমরা শিখেছি, কারও ক্ষতি করবে না, পারলে উপকার করবে। সেটা সারা জীবন আমরা তিন ভাইবোন মেনে চলেছি। এখনো চলছি।’
সংগীতের অমর ভুবনে
বাংলা ছাড়া উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানেন রুনা লায়লা। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচ, আরবি, পারসি, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজিসহ ১৭ ভাষায় গান করেছেন তিনি। পাকিস্তানে নিসার বাজমির সুর করা অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা। রুনাকে দিয়ে নানা ধরনের গান করিয়েছেন এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক।
মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান রুনাকে দিয়ে নিসার বাজমির সুরে গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করে। প্রতিদিন এই সুরকারের ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন রুনা। পরে তা বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে স্থান পায় গিনেস বুকে।

১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর রুনার গাওয়া বাপ্পি লাহিড়ীর সুর করা গান নিয়ে ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশ করে সুপার রুনা অ্যালবাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রথম দিনেই অ্যালবামটির লাখ কপি বিক্রি হয়। উপহার হিসেবে রুনাকে দেওয়া হয় গোল্ড ডিস্ক। অ্যালবামের কাজ করেছিলেন লন্ডনের এবি রোডেস, যেখানে বিটলস গান রেকর্ডিং করত। দেশে–বিদেশে গান গেয়ে দাপুটে বিচরণ করা রুনা লায়লা বরাবরই তাঁর পরের প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার একটি নাম। তিনি নিজেও স্বপ্ন দেখেন এখনকার প্রজন্মকে নিয়ে।
গানের ভুবনে এক চিরন্তন দীপশিখা
ছয় দশক পেরিয়েও সেই কণ্ঠে আছে প্রথম দিনের দীপ্তি। আজও রেডিও, টেলিভিশনে, ইউটিউবে যখন ভেসে আসে তাঁর কণ্ঠ—মনে হয় এক সময়হীন জাদু ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর গানে প্রেম, বিরহ, বেদনা, আনন্দ—সবকিছু একসঙ্গে ধরা দেয় জীবনের মতোই। রুনা লায়লার ভাষ্যে—‘গানই আমার সাধনা, গানই আমার প্রার্থনা। যত দিন গাইতে পারব, তত দিন বাঁচব।’
(প্রথম আলোয় প্রকাশিত রুনা লায়লার সাক্ষাৎকার থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে)