
বিশ্ব যখন প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মমুখী শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে দেশের শিক্ষার্থীদের গতি অনেকটাই ভিন্ন দিকে। বর্তমানে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়ছে কলা ও মানবিক অনুষদভুক্ত সাধারণ বিষয়গুলোতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার ৩৬২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানবিক বিষয়ে পড়ছে ১৯ লাখ ৮ হাজার ৮৩৯ (৪১ দশমিক ৬৯ শতাংশ)। এরপরই রয়েছে সামাজিক বিজ্ঞানে ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আবার এর চেয়ে আলাদা। সেখানে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের শিক্ষার্থীই বেশি।
সূত্রমতে, একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকা ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক লাখ ৫৪ হাজার ৭১৯ জন, তথা ৪৩ দশমিক ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদে। এরপর ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে আছে ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী।
২০২৩ সালের তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
দেশের উচ্চ শিক্ষার্থীদের পড়ার বিষয় পছন্দের এ হার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মানবিক, কমার্স ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয় খোলা হয়েছে। এগুলোর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী আমার দেশকে বলেন, দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে নয়, অনেক ক্ষেত্রে বরং বাধ্য হয়েই সাধারণ বিষয়গুলোতে পড়ছে। কারণ একে তো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়গুলোর আসন কম, অন্যদিকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধারও অভাব রয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিহীন শিক্ষায় এভাবে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকার ও ইউজিসিকে নতুন করে ভাবতে হবে বলে মনে করেন এ শিক্ষাবিদ।
ইউজিসির প্রতিবেদন সূত্রমতে, ২০২৩ সালে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত/অঙ্গীভূত কলেজ/মাদরাসার শিক্ষার্থী ব্যতীত) শিক্ষার্থী ছিল ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার ৩৬২ জন। এর মধ্যে কলা ও মানবিক বিষয়ে অধ্যয়নরত ১৯ লাখ আট হাজার ৮৩৯ জন (৪১ দশমিক ৬৯ শতাংশ), সামাজিক বিজ্ঞানে ১২ লাখ ৫১ হাজার ৩০৯ (২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ), ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ৩৫ হাজার ৫৪৫ (শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ), চারুকলায় এক হাজার ৯৩৩ (শূন্য কলা ও মানবিক অনুষদ নিয়ে দশমিক ০৪ শতাংশ), বাণিজ্যে আট লাখ ২২ হাজার ৯৪৪ (১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ), আইনে ১৯ হাজার ৭৫৪ (শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ), ফার্মেসিতে দুই হাজার ৬৯০ (শূন্য দশমিক ০৬ শতাংশ), বিজ্ঞানে তিন লাখ ২০ হাজার ৩৪৫ (৭ শতাংশ), জীববিজ্ঞানে ২২ হাজার ৮৪৪ (শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ), চিকিৎসাতে ছয় হাজার ৯১৮ (শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ), কৃষিতে ২৩ হাজার ৬০৬ (শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ), প্রকৌশল ও কারিগরি ৭৬ হাজার ৬৭০ (এক দশমিক ৬৭ শতাংশ) এবং অন্যন্য (এমফিল, পিএইচডি, উচ্চতর পর্যায়ে, ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট) পর্যায়ে ৮৪ হাজার ৯৬৫ জন (১ দশমিক ৮৬ শতাংশ)।
সূত্রমতে, জাতীয়, উন্মুক্ত ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজ ব্যতীত ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই লাখ ৯৬ হাজার ৬৯৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানবিকে পড়ছে ৪২ হাজার ২৬৯ জন। এছাড়া সামাজিক বিজ্ঞানে ৪২ হাজার ৪০৪ জন, শিক্ষায় সাত হাজার ৮৯২ জন, চারুকলায় এক হাজার ৯৩৩ জন, বাণিজ্যে ৪১ হাজার ৯৫১ জন, আইনে আট হাজার ২০২ জন, ফার্মেসিতে দুই হাজার ৬৯০ জন, বিজ্ঞানে ৩৭ হাজার ৩৮১ জন, জীববিজ্ঞানে ২২ হাজার ৮৪৪ জন, চিকিৎসায় ছয় হাজার ৯১৮ জন, কৃষিতে ১৯ হাজার ৮২৮ জন, প্রকৌশল ও কারিগরিতে ৫৪ হাজার ৮২৪ জন এবং অন্যান্য (এমফিল, পিএইচডি, উচ্চতর পর্যায়ে, ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট) পর্যায়ে সাত হাজার ৫৬০ জন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫৪৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানবিকে পড়ছে ১২ লাখ ৯ হাজার ২২৫ জন। এছাড়া সামাজিক বিজ্ঞানে ১০ লাখ ১২ হাজার ৪২৪ জন, শিক্ষায় ছয় হাজার ৩১৫ জন, বাণিজ্যে সাত লাখ ৭৬ হাজার ৯২৯ জন, আইনে ১১ হাজার ৫৫২ জন, বিজ্ঞানে দুই লাখ ৭৮ হাজার ১৮৩ জন, প্রকৌশল ও কারিগরিতে ২১ হাজার ৮৪৬ জন এবং অন্যান্য (এমফিল, পিএইচডি, উচ্চতর পর্যায়ে, ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট) পর্যায়ে ৬৮ হাজার ৭১ জন অধ্যয়নরত আছে।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন লাখ ৯৩ হাজার ৫৪১ শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানবিকে পড়ছে তিন লাখ ৫০ হাজার ২৪৬ জন। শিক্ষায় ২১ হাজার ৩৩৮ জন, বাণিজ্যে চার হাজার ৬৪ জন, বিজ্ঞানে চার হাজার ৭৮১ জন, কৃষিতে তিন হাজার ৭৭৮ জন এবং ডিপ্লোমা/সার্টিফিকেট ও অন্যান্য পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯ হাজার ৩৩৪ জন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ/বিভাগভিত্তিক শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে একাডেমিক কার্যক্রম চালুকৃত ১০৩টি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে কৃষিতে দুই হাজার ৯২ জন, (শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ), কলা ও মানবিকে ৩৯ হাজার ২১৫ জন (১০ দশমিক ৯৪ শতাংশ), জীববিজ্ঞানে পাঁচ হাজার ৭৫৪ জন (এক দশমিক ৬১ শতাংশ), ব্যবসায় শিক্ষা ৮০ হাজার ৮৫৭ জন (২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ), প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে এক লাখ ৫৪ হাজার ৭১৯ জন (৪৩ দশমিক ১৭ শতাংশ), স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জনস্বাস্থ্যে ছয় হাজার ৪০৫ জন (এক দশমিক ৭৯ শতাংশ), আইনে ২৩ হাজার ৬০৯ জন (ছয় দশমিক ৫৯ শতাংশ), মেডিসিনে ১৩১ জন (শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ), ফার্মেসিতে ১১ হাজার ৯৮১ জন (তিন দশমিক ৩৪ শতাংশ), বিজ্ঞানে সাত হাজার ৬৫০ জন (দুই দশমিক ১৩ শতাংশ), সামাজিক বিজ্ঞানে ১২ হাজার ৩৮৮ জন (তিন দশমিক ৪৬ শতাংশ), টেক্সটাইল ও ফ্যাশনে ১০ হাজার ৩৫৭ জন (দুই দশমিক ৮৯ শতাংশ), ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সে ৪০৭ (শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ এবং অন্যান্য বিষয়ে দুই হাজার ৮৪৯ (শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ) শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ছিল।
অধ্যাপক ড. হাছানাত আলী বলেন, এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিভাগ বেশি ছিল। বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞাননির্ভর জাতি গড়ে তুলতে গত দেড় দশকে অনেকগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়েও মানবিক, কমার্স ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয় অনুমোদন দিয়ে শিক্ষার্থীদের তাতে পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বিষয় বেশি থাকলে সেদিকেই শিক্ষার্থীরা বেশি ঝুঁকত।
তিনি আরো বলেন, সাধারণ শিক্ষারও দরকার আছে। তবে বর্তমানে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পার করছি। পঞ্চম শিল্পবিপ্লব হাতছানি দিচ্ছে। এসব বিপ্লব মোকাবিলায় আমাদের প্রযুক্তি দক্ষ জনবল তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে।