
মা শব্দটি মানেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, নিরন্তর ত্যাগ আর হাসিমাখা মুখ। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। আমাদের চারপাশে নানা উৎসব, ফুল আর উপহারের ভিড়ে মাতৃত্বের আনন্দ উদযাপন করা হয়। কিন্তু এই আনন্দময় ছবির আড়ালে থেকে যায় সন্তান জন্মের পর অনেক মায়ের নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা। যাকে বলা হয় ‘ব্লু পোস্টপার্টাম’, ‘বেবি ব্লুজ; বা ‘পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন’। মা দিবসের এই বিশেষ দিনে আলোচনা হোক সেই মায়েদের গল্প, যারা এই মানসিক যুদ্ধে প্রতিদিন লড়াই করছেন নিঃশব্দে। চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে সাইকোলজিস্ট ওয়াহিদা পারভীন এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন-
ব্লু পোস্টপার্টাম: সহজ ভাষায় বলা যায় ব্লু পোস্টপার্টাম একধরণের মুড ডিসঅর্ডার, যার কারণে ডিপ্রেশন তৈরি হয়। সাধারণত সন্তান জন্মের কিছুদিন পর মায়েরা ভিন্নধর্মী কিছু অনুভূতির মধ্য দিয়ে যান। যেমন মায়েরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন তাদের মধ্যে নানা ভয় কাজ করে। একইসঙ্গে সন্তান আসায় তাদের মধ্যে আনন্দও কাজ করে। এগুলো খুব স্বাভাবিক বিষয়। তবে গবেষণা থেকে জানা যায় প্রায় ৮০ শতাংশ নারী পোস্টপার্টামের মধ্যে দিয়ে যান। শিশু জন্মের দুই থেকে তিন দিনের ভেতর মায়েদের অতিমাত্রায় `ডিপ্রেসিভ মুডে’র মধ্য দিয়ে যায়। আবার কখনো দেখা যায় তাদের খুব বেশি তার মুড সুয়িং হয়। যেমন সে খুব কান্না করছে অথবা ঘুমে সমস্যা সেই সঙ্গে যেকোনো বিষয় নিয়ে বিরক্ত হওয়া। যদি এমন হয় তাহলে বুঝতে হবে মা ব্লু পোস্টপার্টামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।
ব্লু পোস্টপার্টামের লক্ষণ: ব্লু পোস্টপার্টামের লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় জানান মনোবিদ ওয়াহিদা পারভীন। এগুলো হলো:-
• প্রায়ই কান্না পায়, অথচ কোনো কারণ থাকে না
• আনন্দ অনুভব না করা, এমনকি শিশুর প্রতিও না
• ঘুমের সমস্যা (ঘুমাতে না পারা বা অতিরিক্ত ঘুম)
• অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ক্লান্তি বা আত্মবিশ্বাসের অভাব
• নিজেকে অসহায় মনে হওয়া
• খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত খাওয়া
ব্লু পোস্টপার্টামের কারণ ও সময়কাল: সন্তান জন্মের পর মায়ের শরীরে এক ধরণের হরমোন নিঃসরণ হয়। যেমন ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের অতিমাত্রায় ক্ষরণের ফলে ব্লু পোস্টপার্টাম দেখা দিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে এটা দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে আসে। তবে যদি এই সময় পার হয়ে যাওয়ার পর সমাধান না হয় তাহলে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু যদি এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়, বিষণ্নতা গভীর হয় এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে—তাহলে তা হয়ে যায় ‘পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন’।

সাধারণত সন্তান জন্মের কিছুদিন পর মায়েরা ভিন্নধর্মী কিছু অনুভূতির মধ্য দিয়ে যান। যেমন মায়েরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন তাদের মধ্যে নানা ভয় কাজ করে। ছবি: সংগৃহীত
বেশকিছু কারণে ব্লু পোসড়পার্টামের সমস্যা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের দিকে সমস্যা চলে যেতে পারে। যদি আগে থেকেই মুডডিসঅর্ডারের সমস্যা থাকে তাহলে সন্তান জন্মের পর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হতে পারে। কিংবা তার পরিবারের কারোর যদি এই ধরনের অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা মুড সুয়িং ডিজঅর্ডার থাকে তাহলে মায়ের ক্ষেতেও ডিপ্রেশনের সম্ভবনা বেশি থাকে। কিংবা যদি প্রথম সন্তান জন্মের পর ব্লু পোস্টপার্টাম হয় তাহলেও দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পরেও ‘পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন’ হতে পারে। যদি সময়ের সঙ্গে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায় এবং মা নিজের এবং শিশুর ক্ষতি করার মনোভাব দেখায় তখন অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। এই অবস্থায় মাকে একজন দ্রুত একজন গাইনোকোলজিস্টের কাছে নিতে হবে। একই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে মনোবিদের পরামর্শ মানতে হবে।

সাইকোলজিস্ট ওয়াহিদা পারভীন। ছবি: সংগৃহীত
সমাধানের উপায়: ওয়াহিদা পারভীন বলেন, নতুন মায়ের যত্ন নেয়ার জন্য যিনি থাকেন তাকে লক্ষ্য রাখতে হবে দুই সপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহ এই সমস্যা থাকে কিনা। এটা হতে পারে নতুন মায়ের স্বামী, মা-শ্বাশুড়ি কিংবা অন্য কেউ। যিনিই মায়ের দেখাশোনা করবেন তাকে ব্লু পোস্টপার্টামের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এই সমস্যা দেখা দিলে অপেক্ষা না করে চিকিৎসক এবং মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে।
এছাড়াও স্বামী এবং পরিবারের সদস্যদের নতুন মাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিতে হবে। তার সমস্যায় যে সে একা নয় পরিবার সঙ্গে আছে বুঝাতে হবে। কোনোভাবেই মাকে একাকিত্ব বোধ করানো যাবে না।
মায়ের খাবারের দিকেও বাড়তি নজর দিতে হবে। সন্তান জন্মের পর মাকে স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে হবে। তাই প্রয়োজন হলে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে নতুন মায়ের খাদ্যতালিকা তৈরি করা যেতে পারে।
সন্তান জন্মের পর মাকে কেবল বাচ্চার দায়িত্ব না দিয়ে কিছু সময় তাকে নিজের মত থাকার সুযোগ করে দিতে হবে। অর্থাৎ মা যেন তার নিজের কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পারে। হতে পারে মা একটু বেশি সময় ধরে শাওয়ার নেয়া কিংবা তার পছন্দের বই পড়তে পারে। এমনকি মায়ের ঘুমের বিষয়টিও দেখতে হবে। প্রয়োজনে মায়ের ঘুমের সময় অন্যকেউ শিশুর যত্ন নেবেন।
ওয়াহিদা পারভীন বলেন, আমরা সাইকোলজিস্টরা নতুন মায়েদের যত্নে SNOWBALL টেকনিক অনুসরণ করতে বলি। এটা খুব দারুণ এক কৌশল যা মাকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। এই কৌশলের S মানে Sleep, অর্থাৎ নতুন মাকে পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। N দিয়ে মায়ের Nutrison-এর বিষয়ে বলা হয়। মানে মাকে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। Oতে Omega অর্থাৎ মাকে ওমেগা ফিস ওয়েল খেতে হবে যেটা তাকে অ্যাংজাইটি দুড় করবে। W দিয়ে Walk মানে হাঁটাচলা করার বিষয় বুঝানো হয়। অন্যদিকে B-তে Baby Break, মানে মাকে নিজের মতো সময় দেয়া। A-দিয়ে Adult Time। যার অর্থ মা পরিবারের বড় সদস্য এবং তার সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটাবে। সেটা পাঁচ মিনিট হলেও। অন্যদিকে L দিয়ে Liquid বা পর্যাপ্ত তরল খাবার পানের বিষয়ে জোড় দেয়া হয়। এছাড়াও সবশেষে L দিয়ে Laughter অর্থাৎ মা যেন হাসিখুশি প্রাণবন্ত থাকা।

সন্তানের আগমণে বাবা-মা দুজনের জীবনে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। তাই এই সময়ে যেসব পরিবর্তন দেখা দেবে সে বিষয়ে সন্তান নেয়ার আগে থেকেই সচেতন হওয়া উচিত। ছবি: সংগৃহীত
নতুন বাবা-মায়ের মনের যত্ন: সবশেষে মায়েদের পাশাপাশি বাবাদের বিষয়টিও বলা উচিত। সন্তান হওয়ার পর নতুন বাবাদেরও ব্লু পোস্টপার্টেমের মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। সন্তানের আগমণে বাবা-মা দুজনের জীবনে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। তাই এই সময়ে যেসব পরিবর্তন দেখা দেবে সে বিষয়ে সন্তান নেয়ার আগে থেকেই সচেতন হওয়া উচিত। তাহলে নতুন বাবা-মায়ের সন্তান আসার পর তার সঙ্গে মানিয়ে নেয়া কিছুটা হলেও সহজ হয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে সব সময় একজন পারফেক্ট মা-বাবা হওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। আমরা মানুষ দিন শেষে ভুল হবেই। আর নিজের ভুলগুলোর জন্য নিজেদের ছাড় দেয়া জরুরি। আমরা সবার ভালো লাগার বিষয় বিবেচনা করি। অন্যকে ক্ষমা করি। কিন্তু দেখা যায় দিন শেষে নিজেকে গ্রহণ করার বিষয়টা ভুলে যাই। নতুন বাবা- মায়েদের এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
এ বিষয়ে কোথায় সহায়তা করা হয়: বর্তমানে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে এমন অনেক সংস্থা ও ক্লিনিক রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেল্পলাইন ও অনলাইন থেরাপিও এখন অনেক সহজলভ্য। মা দিবসে প্রতিটি মায়ের অনুভূতিকে সম্মান জানানো উচিত। মাতৃত্ব সহজ বিষয় নয়। সন্তান জন্মের পর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়ার গুরুত্ব বুঝতে হবে। মায়েদের হাসিমুখের আড়ালের সেই অদৃশ্য ক্লান্তি ও কান্না বুঝতে হবে পরিবারের সবার।