
দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠে কার ভুলে এই ট্র্যাজেডি? প্রযুক্তির, প্রশাসনের, নাকি সেই অদৃশ্য মানসিকতার, যেটা বছরের পর বছর ধরে আমাদের সিদ্ধান্তের ভিত গড়ে দেয়? রেল দুর্ঘটনার পর বারবার উঠে আসে এক পরিচিত বয়ান ‘এভাবেই তো করি সবসময়, কিছু হয়নি তো!’ কিন্তু এবার হয়েছে আর ভবিষ্যতেও হতে পারে কারণ এই মানসিকতা আসলে একটা নিঃশব্দ ঘাতক।
এই ‘অভ্যাসগত আত্মবিশ্বাস’ বা হ্যাবিচুয়াল কনফিডেন্স শুধু ট্রেন চালক বা স্টেশন মাস্টারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা ছড়িয়ে আছে পুরো সিস্টেম জুড়ে। পর্যবেক্ষণ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ, নির্দেশনা থেকে প্রয়োগ সবখানে। রুটিনের বাইরে কিছু ভাবার অভাব, নিয়মকে অবজ্ঞা করে নিজের অভিজ্ঞতাকে বড় করে দেখার এই প্রবণতা যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার উদাহরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
একজন অভিজ্ঞ লোকোমাস্টার হয়তো জানেন কোন বাঁক কেমন, কোন স্টেশনে কখন গতি কমাতে হয়। কিন্তু তিনি যদি দিনের পর দিন গতি বাড়িয়ে চালান শুধু এই বিশ্বাসে যে ‘আমি তো জানি, কিছু হবে না’, তাহলে একদিন সামান্য একটা ভুল মুহূর্তের মধ্যে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ অভ্যাস যদি নিয়ম না মানে, তখন তা দক্ষতা নয়, এক ধরনের আত্মতুষ্টি।
আমরা একই প্রবণতা দেখি রাস্তা পারাপারে, কারখানার নিরাপত্তায়, এমনকি হাসপাতালের নিয়মিত চেকআপে গড়িমসিতে। শুধু ট্রেন নয়, সারাদেশে একটা মনস্তাত্ত্বিক সংকট চলছে আমরা নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিই তখনই, যখন বিপদ ঘটে যায়। অথচ সচেতনতা, সতর্কতা আর নিয়ম মানার চর্চা হওয়া উচিত বিপদের আগেই।
এই মানসিকতার মূল শিকড় আমাদের সমাজব্যবস্থায়, যেখানে পুরোনো অভিজ্ঞতাকে সতর্ক সিদ্ধান্তের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যারা নিয়ম মেনে চলে, তাদের বলা হয় বেশি বাড়াবাড়ি করছে, আর যারা নিয়ম ভেঙে অভ্যাসগত আত্মবিশ্বাসে ভাসে, তারা হয়ে ওঠে ‘অভিজ্ঞ ও সাহসী’। এই চর্চা বন্ধ না হলে শুধু ট্রেন দুর্ঘটনা নয়, সব সেক্টরেই বড় ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে এই মানসিকতা বদলাবে কীভাবে?
প্রথমত, প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। শুধু দুর্ঘটনার পর শোক নয়, বরং প্রতিরোধমূলক নজরদারি ও মূল্যায়ন থাকতে হবে নিয়ম ভাঙা অভ্যাসের ওপর।
দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণ ও মনোভাব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। শুধু মেশিন পরিচালনার নয়, বরং নিয়ম মানার পেছনের কারণগুলো বোঝানো দরকার।
তৃতীয়ত, নিয়ম ভাঙার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে উপরের দিক থেকেই; যেন নিচের স্তরেও বার্তা যায় নিয়ম মানা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং তা-ই সত্যিকারের দক্ষতা।
আমাদের মনে রাখা উচিত আত্মবিশ্বাস তখনই মূল্যবান যখন সেটি নিয়ম, সতর্কতা ও বাস্তবতার সঙ্গে ভারসাম্যে করে চলে। অভ্যাসকে অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত করলে, তা আর আত্মবিশ্বাস থাকে না তা হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। অভ্যাসের আত্মবিশ্বাস যদি নিয়ম আর সতর্কতাকে ছাড়িয়ে যায়, তবে সেটি আত্মবিশ্বাস নয় একটি সময় সংশ্লিষ্ট বিপদ।
আমাদের এখনই প্রশ্ন করতে হবে ‘এভাবেই তো করি সবসময়’ বলার আগে, আমরা কি জানি সেই ‘সবসময়’ এর সীমা কোথায়? কারণ হয়তো এবারও কিছু হয়নি, কিন্তু পরের বার যদি ব্যতিক্রম হয়, তবে তার দায় কিন্তু সবার।