মানুষের ভাগ্যটা আজ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আর রাজনীতি নিয়ে নতুন চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। সেটা হলো এই যে, বাংলাদেশের দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটা এখন আরও বেশি অসহ্য হয়ে উঠেছে। দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটা আসলে একদলীয়ই। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, রাষ্ট্র সে দলেরই হয়ে যায়। অপর দল কিন্তু আগের দলের মতোই আচরণ করে। বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, পরের সরকার আগের সরকারের চেয়ে ভালো তো নয়ই, বরং আরও খারাপ হয়ে থাকে। দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটা একদলীয় আরও এক অর্থে। সেটা এই যে, উভয় দলই হচ্ছে বিত্তবানদের দল। সামাজিকভাবে তারা পরস্পরের পরিচিত, ক্ষেত্রবিশেষে আত্মীয়ও, অধিকাংশ সময়েই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ, ওঠাবসা একই রকমের, আচার-আচরণও তাই। দুটি দল হলেও তারা উভয়ই বড় লোকদেরই দল। সে জন্য তাদের এক দলই বলা যায়। লোকে বিকল্প খোঁজে। ভাবে, এ দুই দলের বাইরে যাবে।
কিন্তু যাওয়া সম্ভব হয় না। মাঝে মধ্যে সামরিক শাসন দেখতে পাওয়া যায় কখনো প্রকাশ্যে, কখনো ছদ্মবেশে। কিন্তু অচিরেই টের পাওয়া যায়, ভেতরে ভেতরে তারা ওই একই দলের। তারাও বিত্তবানদেরই স্বার্থ দেখে। স্বার্থ দেখার সেই কাজে যুক্ত হয় আরেক অপশক্তি। সেটি হলো ধর্মীয় মৌলবাদ। এটি আরও বেশি ভয়ানক। সেই ভয়ানক শক্তিকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এই দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থা। যার ফলাফল সবচেয়ে মারাত্মক।
আমরা ব্রিটিশ আমলে ছিলাম; অবশ্যই ভালো ছিলাম না। পাকিস্তান আমলও আমাদের জন্য দুঃসহ। এখন বাংলাদেশে আছি, কিন্তু ভালো আছিÑ এমনটা বলা যাচ্ছে না। কেউ কেউ আছেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আগেই ভালো ছিলাম! কখন, কীভাবে ভালো ছিলেন সেটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। তারা আদর্শায়িত করেন পেছনের দিনগুলোকে। কারণ বর্তমান অসহ্য, ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। অতীতে আমরা মোটেই ভালো ছিলাম না; অসন্তুষ্ট ছিলাম। সে জন্য আন্দোলন করেছি, মুক্তি চেয়েছি। শাসক বদল হয়েছে, এমনকি রাষ্ট্রও ভেঙেছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে; মানুষ যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। তাদের ভাগ্য বদলায়নি, কেবল শাসকই বদলেছে এবং নতুন যারা শাসক হয়েছে, তাদের কেউ কেউ অতীতে যে খারাপ অবস্থায় ছিল তা নয়, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন ধনবান মানুষ এবং তারা একই দলের। একইভাবে শাসন অর্থাৎ শোষণ করছে। এটা আমরা বুঝি, কথাটা আমরা বলিও। কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু করতে পারি না।
দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটেছে। তাকে উন্নতির লক্ষণ বলা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কী শিখছে? সেই প্রশ্নটা তো থাকেই। এটা শুধু গুণগত উৎকর্ষের বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কি সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে, নাকি অসামাজিক হয়ে উঠছে? অসামাজিক হওয়ার অর্থ এখানে শুধু যে অপরাধপ্রবণ হওয়া; তাই নয়, বিচ্ছিন্ন হওয়া। লক্ষ করলে দেখা যাবে, শিক্ষা ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে এবং ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এটা নতুন কোনো সমস্যা নয়। এটা আগেও ছিল। কিন্তু এখন উন্নতির আলোক উদ্ভাসের আড়ালে এটি আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শিক্ষিত মানুষ এখন কেবল নিজের স্বার্থ দেখে, অন্যের স্বার্থ দেখতে চায় না। তার মধ্যে দেশপ্রেম বৃদ্ধি পায় না। সে অসামাজিক হয়ে ওঠে। শিক্ষাকে আমরা জাতির ভবিষ্যৎ বলে বিবেচনা করি। কিন্তু কোন ধরনের মানুষ এ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে? স্বার্থপর নাকি সামাজিকÑ এ প্রশ্নটা প্রাথমিক হওয়া উচিত, কিন্তু হয় না। এ অবস্থা কেমন করে বদল করা যাবে? ছোট ছোট সংস্কার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সেসব সংস্কারকে প্রযুক্ত করতে হবে সমগ্র ব্যবস্থাটার পরিবর্তনের সঙ্গে। নইলে শিক্ষাক্ষেত্রে যেমনটা হচ্ছে, তা অন্যত্রও ঘটতে থাকবে এবং ঘটছেও।
বলা হয় যে, মানুষের চরিত্র ঠিক নেই। অভিযোগÑ মানুষের মধ্যে সহনশীলতার বড় অভাব। দুটোই সত্য। কিন্তু মানুষ তার চরিত্র কীভাবে ঠিক রাখবে, যেখানে সমাজ চরিত্রহীন। চরিত্রহীনরাই তো এখন সমাজের শীর্ষে রয়েছে এবং তাদের আদর্শেই সাধারণ মানুষ দীক্ষিত হচ্ছে। সহনশীলতা অবশ্যই নেই। কেননা, সমাজে লুণ্ঠনই হচ্ছে প্রধান সত্য। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির লালসায় এমন কাজ নেই, যা করতে লোকে পিছপা হয়। মানবিক সম্পর্কগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। রক্ষকরা ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। আমরা যে বিকল্পের কথা বলছি, সেটা নিশ্চয়ই এ সমাজ এখন যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সে জন্য এ সমাজকে ভেঙে সেখানে নতুন সমাজের প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এ নতুন সমাজের জন্য যথোপযুক্ত মতাদর্শ প্রয়োজন। এ মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতেই বিকল্প সমাজ গড়া সম্ভব। মতাদর্শের ব্যাপারটা দার্শনিক।
এ প্রসঙ্গ উঠলেই বলা হয়, এ হচ্ছে বড় বড় কথা। এ রকম ধারণার পেছনে যে যুক্তি নেইÑ তা নয়। মতাদর্শ অনেক সময়ই বাস্তবিক সমস্যার মুখোমুখি হতে চায় না। সাধারণ মানুষ ছোট ছোট সমস্যার কারণে মতাদর্শের কথা ভাবার সুযোগ পায় না। আর মতাদর্শে বিশ্বাসীরা সাধারণ মানুষকে, তাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে তার পথ খুঁজে পান না।
মূল ব্যাপারটা কিন্তু সোজা। সেটা হলো ব্যক্তির মুক্তি ব্যক্তিগতভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। সেটি অর্জন করতে হলে সমষ্টিগত ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। যে কিশোর একদিন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, যুদ্ধ শেষে তিনি পেশা নিয়েছেন শিক্ষকতা। কিন্তু দেখলেন যে, মুক্তি আসেনি। কারণ শাসক বদল হয়েছে ঠিকই, ব্যবস্থার বদল হয়নি। ওই শিক্ষককে আবার আন্দোলনে নামতে হয়েছে। এবার তার আন্দোলনটি পেশাগত। তিনি যে আন্দোলনরত অবস্থায় প্রাণ দিলেন, তাতে এটাই প্রমাণ হলো যে, ব্যক্তিগত মুক্তি তো বটেই, পেশাগত মুক্তিও বিদ্যমান ব্যবস্থায় অর্জন সম্ভব নয়।
আমাদের এ ব-দ্বীপে মাটি শক্ত নয়। তাই খুঁটি গাড়তে হয় এবং খুঁটিকেই অবলম্বন করা চাই। এ খুঁটি হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সমাজে এখন সবাই এ খুঁটি গাড়তে ব্যস্ত। এ প্রতিযোগিতা নিষ্ঠুরতায় পরিণত হয়েছে। এমন ব্যাপক নিষ্ঠুরতা সমাজে আগে কখনো দেখা যায়নি। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি কেমন করে সৎ থাকবে! সৎ থাকতে গেলে হয় সে বিপদে পড়বে, নয়তো পিছিয়ে পড়বে। আর যদি ব্যক্তি সৎ থাকতে পারে, তাহলেও কি সমাজ বদল হবে? মানুষের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করার জন্য এ অসুস্থ সমাজকে বদল করা চাই। এ জন্যই দরকার বিকল্প রাজনীতি। সংগঠিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমাজ বদলাবে। লক্ষ্যটা থাকবে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার। একে সমাজতান্ত্রিক বললেও অন্যায় করা হবে না। কেননা এ সমাজে থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সর্বস্তরে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা। আমাদের জনমাধ্যম, টেলিভিশন, আলাপ-আলোচনায় অনেক কথাই বলা হয়। সেগুলো ফুলঝুরির মতো; কিন্তু মূল সমস্যাটা যে এ অসুস্থ সমাজটাকে বদল করা, সেটা উঠে আসে না।
এখন এ সত্যটা প্রতিষ্ঠিত যে, প্রাইভেট মানেই ভালো আর পাবলিক মানেই খারাপ। এটা শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান। অথচ আমরা যে মুক্তির জন্য লড়েছি, সেটা সব সময়ই ছিল পাবলিকের কাজ, প্রাইভেটের নয়। কিন্তু এখন পাবলিক হেরে গেছে প্রাইভেটের কাছে। সে জন্যই আমাদের এমন দুর্দশা। শেয়ারমার্কেটের কথা ধরা যাক। সেখানে যে কেবল মতলববাজ ও ধড়িবাজরাই যায়; তাই নয়। নিরুপায় সাধারণ মানুষও ভিড় করে। তার কারণ, পাবলিক বিনিয়োগের স্থান অত্যন্ত সংকুচিত। ওই ক্ষেত্রটা প্রসারিত হলে মানুষ সেখানেই যেত। সেখানে না যেতে পেরে মানুষ প্রাইভেটের কাছে যায় এবং বিপদে পড়ে।
বাংলাদেশে যা দরকার তা হলো, পাবলিককে বড় করা; প্রাইভেটের তুলনায়। তাহলেই প্রাইভেট নিরাপদ হবে। আসলে ব্যক্তিও তো বিবেচনার চূড়ান্ত বিন্দু। তাকেই সমৃদ্ধ ও সুখী করা চাই। কিন্তু ব্যক্তি জড়িত সমষ্টির সঙ্গে। যে জন্য সমষ্টির ভাগ্য না বদলালে ব্যক্তির ভাগ্যও বদলাবে না এবং যতটুকু বদলাবে, তা সুরক্ষিত থাকবে। বদলটা এখানেই দরকার। দেশের মানুষ এ বদলের জন্যই সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বারবার তারা দেখেছে প্রাইভেট পদদলিত করছে পাবলিককে। সে জন্যই বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ মোটেই শেষ হয়নি। এ যুদ্ধটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাই সমাজ বদলের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের মূল চরিত্রের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন।
সমাজ বদলের প্রশ্নে দুদলই অনড়। কেননা ওই ঘটনাটা ঘটলে তাদের সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিটাই নষ্ট হয়ে যাবে। জনগণকে তাই এগোতে হবে মুক্তির দিকে। মুক্তির এই যাত্রায় কারা নেতৃত্ব দেবেন? নেতৃত্ব দেবেন তারাই, যারা দেশপ্রেমিক এবং গণতান্ত্রিক। কত দ্রুত তারা এগিয়ে আসছেন এবং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হচ্ছেন, তার ওপরই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। ‘বিকল্প চাই’Ñ এ উপলব্ধিটা এখন প্রায় সর্বজনীন। কিন্তু এর আওয়াজ যেন এর আসল প্রয়োজন সম্পর্কে আমাদের বিভ্রান্ত না করে। সে প্রয়োজনটা হলো সমাজ রূপান্তরের, অর্থাৎ সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন জরুরি। তবেই মানুষের সত্যটা একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের অবস্থানটা নিশ্চিত হবে সবার ওপরে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : শিক্ষাবিদ
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন