ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ আরও বড়
27 April 2020, Monday
এই লেখাটি লিখতে বসে অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ শুনলাম, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দাত হুসাইন প্রায় দুই সপ্তাহ অসুস্থ থাকার পর মৃত্যুবরণ করছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর সঙ্গে আমার আন্তরিক পরিচয় ঘটে আমি নির্বাচন কমিশনে থাকাকালীন। তিনি তখন পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রশাসন, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল। ছিলেন স্পষ্টভাষী মানুষ। তিনি একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন।
ড. সা’দাত অসুস্থ অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কদিন পরই তাঁর স্ত্রী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, তাঁর চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেসব হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। অবশেষে বিশেষ ব্যক্তির সুপারিশে একটি হাসপাতালে তাঁর জায়গা হয়েছে। এ লেখা পর্যন্ত তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন। তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।
একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট নাগরিকের পরিবারকে যদি চিকিৎসার জন্য এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তারও বাইরে। অনেকেই চিকিৎসকদের দোষারোপ করেন। কিন্তু চিকিৎসকদের সুরক্ষার হাতিয়ার কোথায়? এই পেশাকে ঘিরেই পাবলিক হেলথ এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং বিশাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আমরা এত দিন শুনেছি সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কথা, পরিকল্পনার কথা। শত শত কোটি টাকার প্রকল্প, উপজেলায় হাসপাতাল আর আধুনিক যন্ত্রপাতির কথা। কিন্তু এখন মনে হয় সবই শুভংকরের ফাঁকি। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মেলে কম, সবই এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল। বলা হয়, একটি দেশের সামরিক বাহিনীর মান যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া নিরূপণ করা যায় না। তেমনি জরুরি সংকটময় পরিস্থিতি এলে রাজনৈতিক ও বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্ষমতা ও কার্যকারিতা বোঝা যায়। বর্তমান পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা কোথায় আছি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাত। অনেকেই বলেন, করোনাযুদ্ধে প্রস্তুতির জন্য আমরা যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু যথাসময়ে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার পরিবর্তে মন্ত্রী ও নেতারা শুধু আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন।
চিকিৎসার অবস্থা যে ভালো নয়, তা টের পাওয়া যায় ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম থেকেও। ‘সেবা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএমএর হিসাবে চিকিৎসকসহ আক্রান্ত ৪৩০ স্বাস্থ্যকর্মী, ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি বন্ধ, কিশোরগঞ্জে একটি উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা প্রদানের কথা বলে আসছে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা নিশ্চিত করা হয়নি। এর কারণ আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, এখনো প্রস্তুত নই। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জামের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখনো হয়নি। এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের আইসোলেশনে রাখার যে পরিকল্পনার কথা শুনেছি, তাও সঠিক নয় বলে এখন জানা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাত যে দুর্নীতিগ্রস্ত তা এখন আর কোনো নতুন বিষয় নয়। টিআইবি স্বাস্থ্য খাতকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। কিন্তু এখন কী বলা যায়? এমন দুর্যোগের মধ্যেও যে মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছিল তা এন–৯৫ মাস্ক ও রেসপেরেটরের স্ট্যান্ডার্ডে ছিল না বলে ফেরত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, সরবরাহ কীভাবে করা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের অন্য পেশাজীবীদের মতো চিকিৎসকেরাও বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভাজিত। ফলে তাঁরা দলীয় সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে সরকারকে নিরপেক্ষ ও সঠিক পরামর্শ দিতে পারছেন বলে মনে হয় না। এখন এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চিকিৎসকদের রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে ১৮ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের চিকিৎসকেরা যথেষ্ট মেধাসম্পন্ন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত সুরক্ষা না দিয়ে তাঁদের অগ্রসৈনিক বলার কোনো মানে হয় না। এটা একজন সৈনিককে নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর মতো।
যা-ই হোক, আগামীর অশনিসংকেতের মোকাবিলায় কতখানি প্রস্তুতি নিতে পারি, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে ধস নামছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম ভীষণভাবে পড়ে গেছে, ফলে ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি সংকুচিত হবে। সে ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স কমে গিয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি প্রধান ক্ষেত্র সংকুচিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরেকটি বড় ক্ষেত্র তৈরি পোশাক, এই শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব এখন দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় বেকারত্ব বাড়বে, বাড়বে সামাজিক অশান্তি। এসবের কিছু কিছু নমুনা এখনই দৃশ্যমান। সরকারের পক্ষে কয়েক কোটি লোককে দীর্ঘ সময় ধরে ত্রাণ সাহায্য জোগানো সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় দেশের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্র ভেঙে পড়বে আইনশৃঙ্খলা, বাড়বে দুর্নীতি।
সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু সব প্রচেষ্টার মধ্যে যে সমন্বয় করা প্রয়োজন, সেখানেই বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন মানুষকে যত দূর সম্ভব নিজ গৃহে অথবা মহল্লায় আটকে রাখা। সামাজিক দূরত্ব, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মধ্য দিয়ে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে হবে। শুধু মুখে বললেই হবে না, মাঠে রয়েছে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ। তাদের যে কারণে নিয়োগ করা হয়েছে, সে কর্ম সম্পাদনের জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া। অন্যথায় মুখের কথায় মানানো যাবে না।
যেসব দেশে এ ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান, সেখানে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ায় এ পর্যন্ত ১৫ হাজার মানুষকে জেলে পাঠানো হয়েছে। ত্রাণসামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা না করলে করোনাভাইরাস সহজে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এর দায়িত্বও পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীকে দেওয়া সম্ভব ও উচিত বলে মনে করি।
মানুষকে যত দূর সম্ভব ঘরে রাখা এবং ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা না হলে করোনা মোকাবিলা মোটেও সহজ হবে না। চিকিৎসাসেবা ও এর সুরক্ষা এখন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ এবং অপর চ্যালেঞ্জ সামাজিক ও খাদ্যনিরাপত্তা। এ দুটি বিষয়ই এখন বাংলাদেশের সামনে জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু সরকার নয়, দেশের সবাইকে যুক্ত হতে হবে। তবে আমাদের মতো দেশে যেখানে সরকার ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণই সর্বক্ষেত্রে, সেখানে সরকারের দায়িত্বই বেশি।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য, করোনা-উত্তর বিশ্ব আগের জায়গায় ফিরবে না। পরিশেষে কামনা করব স্বাস্থ্যসেবা থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন