১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের নব্য ধনিকদের যাত্রাপথ অনুসন্ধান করে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমি একটি প্রবন্ধ (প্রচ্ছদকাহিনি) লিখেছিলাম, শিরোনাম ছিল ‘কোটিপতি: মেড ইন বাংলাদেশ’। সম্ভবত এর আগে বা এই সময়েই বর্তমান প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের অনুসন্ধানী একটি সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছিল তৎকালীন সাপ্তাহিক একতায়। এর শিরোনাম ছিল ‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনি’। পরে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি এখন বাজারে নেই, তবে এটি বাংলাদেশে ধনিক শ্রেণির উত্থানপর্ব ও তার ধরন বুঝতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনাযোগ্য।
আমার অনুসন্ধানে বাংলাদেশের নব্য ধনিক শ্রেণি গঠনের দ্বিতীয় পর্বে ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেয়েছি। প্রথম পর্বে ছিল লাইসেন্স, পারমিট, চোরাচালানি, মজুতদারি, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা, সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্বে এর সঙ্গে যোগ হয় ব্যাংকঋণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা লাভ। ব্যাংকঋণের সুবিধা বাড়ে, ঋণখেলাপিও বাড়ে। ব্যবসা ও সরকারি ক্ষমতার মধ্যে যোগাযোগ ও চুক্তির নতুন বিন্যাস ঘটে। নব্য ধনিক শ্রেণির উপস্থিতি যত স্পষ্ট হতে থাকে, তত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়ার হার বাড়তে থাকে, আবার এই হস্তান্তরে ধনিক গোষ্ঠীর সম্পদ আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতেই ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ঋণখেলাপিদেরই নতুন ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের মালিক হিসেবে দেখা যেতে থাকে। দেখা যায়, একজন যত পরিমাণ ঋণখেলাপি, তার একাংশ দিয়েই তিনি অনায়াসে নতুন ব্যাংক খুলে বসেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক যোগাযোগ, লেনদেনের ব্যবস্থা সম্পদ কেন্দ্রীভবনের একটি কার্যকর পথ হিসেবে দাঁড়াতে থাকে। রেহমান সোবহানের একাধিক লেখায় এই সময়কালের বিশ্লেষণ আছে।
বাংলাদেশের নব্য বিত্তবান শ্রেণি অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে আমি যে প্রধান ধরন পাই, তা বোঝাতে ‘লুম্পেন কোটিপতি’ পদ ব্যবহার করি প্রথম তখনই। লুম্পেন কোটিপতি বলতে আমি বুঝিয়েছি এমন একটি শ্রেণি, যারা নিজেদের বিত্ত অর্জনের জন্য উৎপাদনশীল পথের চেয়ে দ্রুত মুনাফা অর্জনে অন্যান্য সহজ ও চোরাই পথ গ্রহণে বেশি আগ্রহী থাকে। এগুলোর মধ্যে চোরাচালানি, মাদক ব্যবসা, ব্যাংকঋণ লোপাট, জবরদখল, জালিয়াতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর জন্য সব অপরাধের পথ তারা গ্রহণ করে নির্দ্বিধায়।
তত দিনে আন্তর্জাতিকভাবেও সমাজবিজ্ঞান চর্চায় ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’ ধারণাটি পরিচিতি পেয়েছে। লুম্পেন বুর্জোয়া দুই ভাষার দুই শব্দ। লুম্পেন শব্দটি জার্মান। বুর্জোয়া শব্দটি ফরাসি, যা পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের কালে ব্যবহৃত হয় তৎকালীন মধ্যবিত্ত এবং পরে ধনিক শ্রেণি বোঝাতে। পুঁজিপতি শ্রেণির উৎপাদন বিচ্ছিন্ন লুটেরা ধরন বোঝাতে এ দুটি শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন একজন অস্ট্রিয়ান লেখক, ১৯২৬ সালে। প্রথম ইংরেজি ভাষায় এর ব্যবহার করেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ব্যারেন ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত পলিটিক্যাল ইকোনমি অব গ্রোথ গ্রন্থে। পরে এই শব্দবন্ধ বিশেষ পরিচিতি পায় জার্মান-মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের (১৯৭২) লুম্পেন বুর্জোয়াজি অ্যান্ড লুম্পেন ডেভেলপমেন্ট: ডিপেন্ডেন্সি, ক্লাস অ্যান্ড পলিটিকস ইন ল্যাটিন আমেরিকা গ্রন্থের মাধ্যমে। তিনি এই গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীন প্রান্তস্থ দেশগুলোতে পুঁজিবাদের বিকাশ আলোচনায় বিশেষভাবে লক্ষ করেন এমন একটি শ্রেণির বিকাশ, যারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ঝুলে থাকে, নিজস্ব অর্থনীতির উৎপাদনশীল বিকাশের বদলে যেকোনোভাবে অর্থবিত্ত অর্জনের পথ গ্রহণ করে, নিজেদের স্বার্থে বহুজাতিক পুঁজির আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকে।
যা হোক, বাংলাদেশে আশির দশক ছিল নব্য ধনিক শ্রেণির জন্য খুবই সুবর্ণ সময়। একদিকে তখন বড় দুর্নীতিবাজ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তির নেতৃত্বে স্বৈরাচারী শাসন, অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির সংস্কার কর্মসূচিতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হস্তান্তরের নীতিমালার চাপ নব্য ধনিকদের জন্য খুবই অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ক্ষমতাবানদের সঙ্গে যোগাযোগে দক্ষ ব্যক্তিরা রাতারাতি তখন অনেক সম্পদের মালিক হয়ে যান, এর জন্য তাঁদের উদারভাবে ব্যাংকঋণও দেওয়া হয়। এটা সম্ভব হয় ক্ষমতার সঙ্গে একটা অংশীদারত্বের চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন করার কারণে। রাষ্ট্র-ব্যবসা-ধর্ম-লুণ্ঠনের এ রকম প্যাকেজ বাংলাদেশে এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
দুর্নীতি, লুণ্ঠন, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের যে ভিত্তি তখন নির্মিত হয়, তা দিনে দিনে আরও শক্ত হয়েছে। কেননা, সেই সময় বিন্যস্ত শাসন-দুর্নীতির পথেই পরবর্তী সরকারগুলোও অগ্রসর হয়েছে। তাই একদিকে দুর্নীতির শত হাত-পা বিস্তার, অন্যদিকে সম্পদ ও ক্ষমতায় কেন্দ্রীভবন-দুটিই ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। সেই হিসাবে আশির দশকের দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচারী শাসক পরবর্তী শাসকদের একজন পথিকৃৎ হিসেবে নিজে গর্ববোধ করতে পারেন। পরবর্তী সময়ের শাসকেরা বহুভাবে তাঁকে অনুসরণ করেছেন।
যথাযথ অনুসন্ধানে দেখা যায়, এখন আমরা প্রবেশ করেছি বিত্তায়নের তৃতীয় পর্বে, যখন ব্যাংকঋণের মধ্যে সম্পদ লুণ্ঠন সীমিত নেই। আকাঙ্ক্ষা ও সুযোগ দুটিই এখন অনেক বেশি। তাই পুরো ব্যাংক খেয়ে ফেলা, এমনকি সর্বজনের সব সম্পদই এখন বাংলাদেশে এই শ্রেণির কামনা-বাসনার লক্ষ্যবস্তু। বৃহৎ চুক্তিতে বৃহৎ কমিশন, জমি-নদী-খাল-বন দখল, সর্বজনের সম্পদ আত্মসাৎ, মেগা প্রকল্পে মেগা চুরির রাস্তা তৈরিসহ পুরো দেশই এখন ভোগ্যবস্তু।
দুর্নীতির বিভিন্ন পর্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমর্থন বা অংশগ্রহণ বরাবরই ছিল নির্ধারক। মন্ত্রী, আমলাদের সহযোগিতা বা অংশীদারত্বের ব্যবস্থারও তাই বিকাশ ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে লুম্পেন রাজনীতিবিদ ও লুম্পেন আমলার বিকাশ ঘটেছে, যাঁরা বৃহৎ কমিশন, বড় আকারের ঘুষের মাধ্যমে অর্থবিত্ত অর্জন করে নতুন শ্রেণিতে উত্তরণ লাভ করছেন। এর সঙ্গে যুক্ত আরেক গোষ্ঠীর কথা বলা দরকার, এরা লুম্পেন বিশেষজ্ঞ বা কনসালট্যান্ট, যারা এসব কাজে বৈধতা দিতে নিজের বিশেষজ্ঞ পরিচয় বিক্রি করে, ধ্বংসের প্রকল্পকে উপকারী প্রকল্প বলে ঘোষণা দেয়, এর বদলে নিজেরাও দ্রুত অর্থবিত্তের মালিক হয়। লুম্পেন শ্রেণির সকল অংশের একটি বৈশিষ্ট্য অভিন্ন: এই দেশে সম্পদ আত্মসাৎ আর অন্য দেশে ভবিষ্যৎ তৈরি। সুতরাং শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, নদী, বায়ু, পরিবেশ বিপর্যস্ত করে এই দেশকে চরম নাজুক অবস্থায় ফেলতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই।
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে এই শ্রেণি যেভাবে সংহত হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনীতির নির্দিষ্ট ধরনের বিকাশও সম্পর্কিত। নানা চোরাই পথে কোটি-কোটিপতি হওয়ার চেষ্টা যারা করে, তাদের জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বাধীন গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, স্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা, স্বাধীন বিদ্যাচর্চা-সংস্কৃতিচর্চা বিপজ্জনক। তাই এই গোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত ক্ষমতা কতিপয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত রাখা, যাদের সঙ্গে সহজেই সমঝোতা, অংশীদারত্ব, চুক্তি করা সম্ভব। তাদের অংশীদার বানিয়ে তরতর করে বিত্তের সিঁড়ি অতিক্রম করা সহজ। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যত অস্বচ্ছ ও অগণতান্ত্রিক হবে, ততই তাদের সুবিধা। তাদের জন্য তাই একই সঙ্গে দরকার একটি নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা, স্বৈরতন্ত্রী আবহাওয়া, যেখানে ভিন্নমত ও স্বাধীন চর্চার ওপর চড়াও হওয়ার জন্য নানা ব্যবস্থা সক্রিয় থাকবে, যার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বা বিচারব্যবস্থার আশ্রয় গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।
তিন দশক আগের সেই লেখায় লিখেছিলাম, ‘...লুম্পেন উন্নয়ন লুম্পেন বুর্জোয়া তৈরি করে, বিকাশ ঘটাতে থাকে (এমন শ্রেণির) যার বেশভূষা ও জৌলুশ বুর্জোয়ার, চিন্তা সামন্ত তালুকদারের এবং ভূমিকা চোর কিংবা ডাকাতের।’ দেশ-বিদেশে কোটি মানুষের শ্রমে দেশের সম্পদ বেড়েছে হাজার গুণ, কিন্তু ক্ষমতাবানদের এই বৈশিষ্ট্যই এখনো দাপটের সঙ্গে অব্যাহত আছে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন