
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও কিছু পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যদের গা-ছাড়াভাবের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। প্রায় প্রতিদিনই হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপারাধমূলক কর্মকা- চলেছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। যারা দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন, তাদের দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। এমনকি যেসব কর্মকর্তা অবসরে চলে গিয়েছিলেন, তাদেরও বাহিনীতে ফিরিয়ে এনে বসানো হয় উচ্চপদে।
পুলিশ সদর দপ্তর নিশ্চিত হয়েছে, সরকারকে বিতর্কিত করতে নতুন করে পদায়ন করাসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরা অলসতা দেখাচ্ছে। পাশাপাশি পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও ফাঁস করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। আর এসব রোধ করতে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ইউনিট, রেঞ্জ ও জেলাগুলোতে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা ছদ্মবেশে ওই ‘অলস পুলিশদের’ চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজনরা এখনো সক্রিয় আছে। তারা নানা কায়দায় তথ্য পাচার করছেন বলে অভিযোগ আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ভোল্ট পাল্টে আওয়ামী লীগবিরোধী হওয়ার চেষ্টা করছেন। এ চেষ্টা করে কেউ সফল হয়েছেন। আবার কেউ ব্যর্থ হচ্ছেন। এমনকি অর্থ খরচ করে ভালো স্থানে পোস্টিং নিয়েছেন। যেসব কতিপয় কর্মকর্তা পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন তারা কিন্তু গত ১৬ বছর সব ধরনের সুযোগ নিয়েছেন। তারা ওই সময়ে চাকরিচ্যুত হননি। অথচ এখন তারা বিশাল আওয়ামী লীগবিরোধী হয়ে আছেন।
তিনি আরও বলেন, মামলা হওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছু কর্মকর্তা পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তার নাম আছে। গত সরকারের আমলে তারা ভালো অবস্থানে থাকলেও কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনবিরোধী ছিলেন না। পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। এমনও পুলিশ সদস্য আছেন তারা সিনিয়র কর্মকর্তাদের গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছেন। তাদের মামলা থেকে নাম দ্রুত বাদ দিলে পুলিশের জন্যই মঙ্গল।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পুলিশের দুইশোর বেশি কর্মকর্তা আত্মগোপনে থাকলেও তাদের আস্থাভাজনরা বিভিন্ন ইউনিটির গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন। সেখান থেকে তারা কৌশলে সব ধরনের কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ আছে। এমনকি তাদের মাধ্যমে কেউ কেউ তথ্য পাচার করারও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বদলিবাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা অনিয়মেও জড়িত আছেন কেউ কেউ। আত্মগোপনে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়ার পরও রহস্যজনক কারণে তারা আছেন বহাল তবিয়তে। আবার কিছু সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তাদের আসামি করায় কিছুটা সমালোচনা রয়েছে। যারা জুলাই-আগস্টের হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকায় মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আসামি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে পাঁচ মাসের বেশি। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অপরাধীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে সরকারের হাইকমান্ড। নিয়মিত চিরুনি অভিযান হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। রাস্তায় থাকছে না পুলিশের কোনো ধরনের টহল। রাত গভীর হলে নিস্তব্ধতা দেখা দেয়। এমনকি থানার সামনেও থাকে সুনসান নীরবতা।
অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটিতে কর্মরত সদস্যরা গা-ছাড়াভাবে থাকছেন। এমনকি আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীরা জামিন নিয়ে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে কয়েক মাস ধরে দেশের আইনশৃঙ্খলা অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা দফায় দফায় বৈঠক করে চলেছেন। খুনখারাবি, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে।
পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারামুক্ত হওয়ার পর থেকেই অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে। প্রকাশ্য তারা অপরাধমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডকে রুখতে পুলিশ নানা কৌশল নিয়েও নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। যারা জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। তালিকাটি সারা দেশের পুলিশের ইউনিটগুলোতে পাঠানো হয়েছে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপনে আছেন। টিপু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুলিশে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট থাকবে না। কেউ সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করবে তাদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গণঅভ্যুত্থানে অতি বল প্রয়োগ করা পলাতক পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। আমাদের কাছে তথ্য এসেছে, সরকারকে বিতর্কিত করতে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত গা-ছাড়াভাবে চলছে। অলসভাবে তারা ডিউটি করছে। এসব ‘অলস কর্মকর্তাদের’ চিহ্নিত করতে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিট, রেঞ্জ ও প্রতিটি জেলায় গোপনে কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সবাইকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন পাঠাবে পুলিশ সদর দপ্তরে।
তিনি আরও বলেন, কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দমনপীড়ন চালায়। গুলিতে শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজন, পুলিশ, আনসারসহ প্রায় এক হাজারের মতো প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা এই প্রথম। এই নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে এখনো। আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের বড় বড় নেতা চলে যান আত্মগোপনে। তাদের মতোই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত থাকেন আত্মগোপনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা বেপরোয়ার বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরসহ সরকারের সবকটি গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশের বলপ্রয়োগ করেছে তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করে। প্রাথমিকভাবে ওইসব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, রাত নামতেই অলিগলি থেকে রাজপথের অধিকাংশ এলাকা চলে যায় ছিনতাইকারীদের দখলে। ঢাকার মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ীসহ একাধিক স্থানে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নগরবাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। গণঅভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুলিশের মনোবল ও তৎপরতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের উদ্যম নেই। অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী-ডাকাত দল ছিনিয়ে নিচ্ছে অর্থ ও মালপত্র।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাতের ঢাকায় ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের সক্রিয়তা কম। টহল পুলিশের দেখাও মেলে না। আবার ছিনতাই হওয়া অর্থ ও মালপত্র উদ্ধারের নজিরও কম। ফলে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছেই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইকারী ধরতে তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। প্রতিদিনই ঢাকায় ছিনতাইকারী ও ডাকাত গ্রেপ্তার হচ্ছে। পটপরিবর্তনের আগে প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠরা এখনো বিভিন্ন ইউনিটিতে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া এবং এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের আস্থাভাজনরা এখনো বিভিন্ন দপ্তরে বহাল তবিয়তে। তার মধ্যে শেখ সুরাইয়া ঊর্মি, এসি (প্রকিউরমেন্ট) লজিস্টিকস বিভাগে নিয়োগ দেন হাবিবুর রহমান। তাদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তার বিরুদ্ধে ভুয়া বিল ও টেন্ডারের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাছাড়া ঊর্মির সঙ্গে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার অশ্লীল ফোনালাপ ভাইরাল হয়েছিল। পুলিশ পরিদর্শক নাজমা আক্তার ওসি-রেশন স্টোর হিসেবে প্রায় চার বছরের অধিক সময় ধরে কর্মরত আছেন। হাবিবুর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবেই পরিচিত আসমা আক্তার সোনিয়া এসি-সিআরও হিসেবে কর্মরত আছেন। সোনিয়া নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ অফিসে কর্মরত এসআই খবিরুল ও এসআই মাহফুজা। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ইমরান (সাবেক ফরেনসিক ও সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিম) বর্তমানে বিশেষ পুলিশ সুপার গাজীপুর, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. মহিউদ্দিন ও টিআই মানব শাহজাদা, ওসি-রেশন ইন্সপেক্টর মো. বদিউজ্জামান, ওসি-এমটি এসআই ফারুক, আরওআই আসমাউল হোসনা, আরও-১ এসআই জিয়াউর রহমান, আরও (ফোর্স) এসআই ফুয়াদ বিন রশিদ কর্মস্থলে থেকে এখনো সক্রিয় আছেন নানা অপরাধে। তারা সাবেক সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলীর আস্থাভাজন। তাদের বিরুদ্ধে রেশনসহ নানা কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তাদের মধ্যে কেউ বদলিবাণিজ্যতেও লিপ্ত আছেন। তারা সঠিকভাবে ডিউটিও পালন করছেন না। জেলাগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।