সেদিন গিয়েছিলাম রায়েরবাজার বস্তির গলিতে। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের উল্টো দিকে। গলিতে ভিড় করে আছে যে শিশুরা, তাদের চোখেমুখে অপুষ্টির ছাপ। শীর্ণ দেহ, রোগা মুখ, মায়াভরা চোখ। আমাদের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাতানা বালুয়ায় গিয়েও শিশুদের চোখেমুখে অপুষ্টির স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পাই। বয়স্ক মানুষেরাও সব রোগা রোগা চেহারার। এদের নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন:
ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে—ম্লানমুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী; স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি, যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার—
তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি,
নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি,
মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান,
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া।
বিশ্বব্যাংকই বলছে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে ভালো করছে। ২০১০ থেকে ২০১৬, এই ৬ বছরে ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু এখনো আমাদের চার ভাগের এক ভাগ মানুষ গরিব। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ মানুষ হতদরিদ্র।
আর বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দারিদ্র্য কমার হারে রয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্য। রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য বেড়েছে। রাজশাহী আর খুলনা বিভাগে দারিদ্র্য কমছে না, স্থির আছে। আরও একটা বড় উদ্বেগের বিষয়, শহর এলাকায় দারিদ্র্য। এ বিষয় নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা বলছেন, শহর এলাকার গরিব মানুষের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, স্যানিটেশন—অনেক দিক দিয়েই তারা পিছিয়ে আছে মর্মান্তিকভাবে, কিন্তু তাদের দেখার কেউ নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, গ্রাম ছেড়ে ক্রমাগতভাবে মানুষ শহরে আসছে।
বাংলাদেশে গরিবি কমানোর প্রয়াসে সাফল্যের কথা আমরা জানি, মানি। কিন্তু এ নিয়ে তুষ্ট থাকার কিছু নেই। বাংলাদেশের অবস্থা এই ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে ভালো। কিন্তু শ্রীলঙ্কার চেয়ে বহুগুণে খারাপ, এমনকি পাকিস্তানের চেয়েও অনেক খারাপ। আর আমাদের জিডিপি বাড়ার সঙ্গে যে হারে দারিদ্র্য কমার কথা ছিল, সে হারে কমছে না। কৃষিনির্ভর এলাকাতে দারিদ্র্যের হার খুব বেশি। শিল্প-কলকারখানা যেসব এলাকায় আছে, সেখানে দারিদ্র্য কম।
বাংলাদেশ দেশটার জন্মই হয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রশ্নে অসন্তোষ থেকে। ষাটের দশকে ড. রেহমান সোবহানের মতো অর্থনীতিবিদেরা বলতে লাগলেন, পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি বিরাজমান, পাকিস্তানের দুই অংশ, পূর্ব আর পশ্চিমে দুই অর্থনীতি। সোনার বাংলা শ্মশান কেন? এই পোস্টার ছাপা হয়েছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে, ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে, তাতে একপলকে জানা গিয়েছিল, দুই অঞ্চলে অর্থনীতিতে কত বিরাট বৈষম্য। আর ষাটের দশক থেকেই আওয়ামী লীগ তার ম্যানিফেস্টোতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা জোরের সঙ্গে বলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে সব সময় বলতেন, গরিব আরও গরিব হবে, ধনী আরও ধনী হবে, এটা চলবে না। তিনি গরিব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলতেন।
কিন্তু এখন আমরা কী দেখতে পাচ্ছি?
অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। দ্রুত মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি বা ধনী হওয়ার যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অতিগরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি’ বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮ থেকে প্রথম আলোয় জাহাঙ্গীর শাহের রিপোর্ট (২০ জানুয়ারি ২০২০)।
আমরা অতিধনী উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম হয়েছি। আর আমাদের দেশের বহু মানুষ এখনো তিন বেলা ঠিকভাবে খেতে পায় না। বহু শিশু স্কুলে যায় না খেয়ে।
রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরি। দেখি, পথের ধারে ফুটপাতের ওপরে নারী-পুরুষের সংসার। সেইখানে চুলা জ্বালিয়ে তারা ভাত রান্না করছে। রাতের বেলা পলিথিন দিয়ে পার্ক কিংবা সরকারি অফিসের দেয়াল ঘেঁষে ছোট্ট একটা তিনকোনা ছাউনি বানাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ফণীর সময়, এর আগে পরে শীতের মধ্যে বৃষ্টি হলো, রাস্তার ধারে থাকা এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠছিল। আমাদের অফিস যেখানে, কারওয়ান বাজারে, একটা পরিবার সারাটা দিন, বাসের নিচে দিনের বেলাটা কাটিয়ে দেয়। দুটো শিশু বাসের নিচে ঘুমায়, খেলা করে। পাঁচটার পরে বাসটা চলে যায়, তারা উঠে আসে বহুতল অফিস ভবনের এক পাশের উঁচু বেদিতে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলি: আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির পরের অংশে আছে:
সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে—
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে। এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা—এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা... (এবার ফিরাও মোরে)
অন্যদিকে খবর পড়ি, চারটি ব্যাংকিং কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা সরিয়ে একজন প্রশান্ত কুমার হালদার সাড়ে তিন হাজার কোটি বিদেশে সরিয়ে চম্পট দিয়েছেন। বড়লোকেরা বড়লোক হোন, কিন্তু কর দিন, আইনকানুন মানুন, আর দেশের টাকা দেশে বিনিয়োগ করে শিল্প-কলকারখানা করুন, দেশের মানুষের কর্মসংস্থান হোক, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরুক। কিন্তু ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করবেন, তারপর পলায়ন করবেন, আর তারপর আমরা বলব, হায় হায় গেল গেল, এ আর কত!
এবার গতকালকের পত্রিকার খবর পড়ুন: ‘দেশের ব্যাংক খাতে যত ঋণ রয়েছে, তার ১১ দশমিক ২১ শতাংশই রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকদের হাতে। টাকার অঙ্কে এ ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৩১ কোটি। ব্যাংকের পরিচালকেরা তাঁদের নিজ ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংক থেকে এসব ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে দেশের ২৫টি ব্যাংকের পরিচালকেরা তাঁদের নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। আর অন্যান্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।’ (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২০)
সত্তরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তেল খাইতে খাইতে জিহ্বা বড় হইয়া গিয়াছে। দয়া করিয়া এইবার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন। বেশি লোভ করিলে জিহ্বা কাটা যাইবে।’ ওই বক্তৃতায় তিনি বস্তি এলাকার উন্নয়নের জন্য কী করা দরকার, তার হিসাব করার জন্য আমলাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। (দৈনিক আজাদ, ৪ জানুয়ারি ১৯৭১)
তারপর কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা গেল, আমাদের গরিব ধনীর পার্থক্য কোনো দিন তো ঘুচলই না। বরং দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে, বেড়েই যাচ্ছে। অতিধনী উৎপাদনে আমরা ফার্স্ট হয়েছি। বিজ্ঞাপনের সংলাপের মতো আমাদের বলতে হবে, মা মা আমি ফার্স্ট হয়েছি। দুর্নীতি, বাড়তি শক্তি জোগায়।
না, আমাদের অর্জনকে আমি খাটো করে দেখছি না। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, গার্মেন্টস সেক্টর, জনসংখ্যার অর্ধেক তরুণ, তরুণ প্রজন্মের দ্রুত নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষমতা, এবং আইটি সেক্টর—বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধি দিচ্ছে। দারিদ্র্যও কমছে। কিন্তু বৈষম্য বাড়ছে। আমাদের অঙ্গীকার ছিল বৈষম্যহীন শোষণহীন সমাজের।
আমরা যেন আমাদের মৌলিকতম অঙ্গীকার, যার ভিত্তিতে এই দেশটাকে আমরা তৈরি করেছিলাম, তা ভুলে না যাই।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন