দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ফেনী
25 May 2023, Thursday
‘যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব দরজায়;/ফেনী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গরজায়।’/ কবি-কিশোর সুকান্তের কবিতার সেই ফেনী শহরের লোক আমি নিজেই। এখানে পূর্ব ‘দরজা’ বলতে তদানিন্তন ভারতবর্ষের পূর্বাংশকে বোঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কলকাতার মতো ফেনীতেও আঘাত করেছিল। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি,/ বোম ফেলেছে জাপানি; / বোমের ভিতর কেউটে সাপ;/ ব্রিটিশ বলে, ‘বাপরে বাপ’। এ কথাটি বিশ্বযুদ্ধের সময় ফেনীতে বহুল প্রচলিত ছিল। কথাটির ভেতর দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও জাপানিদের প্রশংসা একই সাথে ফুটে উঠেছে। ফেনীতে থাকতেন বর্তমান মাগুরা জেলার সুফি সদরুদ্দীন রহ: নামে একজন কামেল আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। বিশ্বযুদ্ধের সময় একদিন সতর্কতা সঙ্কেত রূপে সাইরেন বেজে উঠল, সবাই ছুটে গিয়ে মাটির নিচে পাকা বাঙ্কারে আশ্রয় নিলো। অনেকক্ষণ ধরে জাপানিদের বোমা বর্ষণ চলল। একপর্যায়ে সুফি সদরুদ্দীন রহ: বাঙ্কার থেকে মাথা বের করে বাইরে দেখছিলেন; এমন সময় গোলার একটি আঘাতে তিনি হঠাৎ প্রাণ হারান। সুফি সদরুদ্দীন রহ:-এর কবর আছে ফেনী শহরের কয়েক মাইলে পশ্চিমে গজারিয়া গ্রামে। প্রাসঙ্গিক বইপত্রেও তার জীবনীর উল্লেখ আছে।
ফেনীতে আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের সৈন্যরা থাকত বিশ্বযুদ্ধকালে। আমরা ছোটবেলায় তাদের অনেক পাকা স্থাপনা দেখেছি যেগুলো ছিল শক্ত ইটের তৈরি। কোনো কোনো বাড়ির উঠান ভর্তি ছিল পাকা ড্রেন। এমনকি, পাঁচগাছিয়া রোডের (বর্তমান শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক) আনসার অফিসটিও ছিল ওদের পাকা স্থাপনা। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের একজন স্যার ছিলেন শহরতলির রামপুর গ্রামের। তিনি একদিন স্কুলে বললেন, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আফ্রিকার ঘানার একজন কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তাদের কয়েকজনকে দেখে সৈন্যটি ডাকছিল। সৈন্যটির নাম মুসা অ্যাডডেইল্লা। আমাদের ওই স্যারের তখন বালক বয়স। ওই সৈন্যটি মুসলিম ও ব্রিটিশ পক্ষে মিত্রশক্তির হয়ে বিশ্বযুদ্ধ করতে এসেছিল। ‘স্যার’ এত বছর পরও সে সৈন্যের নাম মনে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি আমাদের ‘মৌলভী স্যার’ নামে পরিচিত এবং মূল নাম কলিমুল্লাহ।
ফেনীর শহরের মধ্যবর্তী রাজার ঝির দীঘি (ত্রিপুরার মহারাজ কুমারীর নামে ১৮৩০ সালে খননকৃত)। এই দীঘির উত্তর-পশ্চিম কোনায় পুলিশ কোয়ার্টারের কাছে কয়েকটি মরা তালগাছ ছিল। কেউ বলেন, বজ্রপাতে; কেউবা বলেন, জাপানের বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে এসব তালগাছ মরে গেছে। আসল ব্যাপার কী কে জানে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই রাজার ঝির দীঘির দক্ষিণ পাশে একজন (দৃশ্যত সাধারণ) মুচি বসত। সে পথের ধারে লোকের জুতা ও স্যান্ডেল সেলাই করত। তার হাতে নাকি একটি ঘড়ি ছিল, যা জাপানিদের গোয়েন্দা যোগাযোগের যন্ত্রবিশেষ। বারবার কানের কাছে সেটিকে নেয়া লক্ষ করে ব্রিটিশ সরকারের জনৈক গোয়েন্দা ওই মুচিকে একদিন ধরে ফেলেন। এই নিয়ে অনেক কাহিনী রচিত হয়েছে। তবে জাপানিদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক যে বিস্তৃত ছিল, তা-ই বোঝা যায় এ ঘটনা থেকে।
ফেনীর শহীদুল্লাহ কায়সার রোডে (পাঁচগাছিয়া রোড) টেলিগ্রাফ অফিসের বিপরীতে, ‘পাদ্রি কুটির’ নামে কিছু পাকা ভবন আছে। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানের বোমা আতঙ্কে একদিন তদানিন্তন বাংলা প্রদেশের গভর্নর (খুব সম্ভবত তার নাম জন হান্ট) তার সঙ্গী সাথী নিয়ে এই পাদ্রি কুটিরের বড় ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এভাবে সে দিন তিনি এবং তার সাথীরা বেঁচে যান। যুদ্ধের সময়ে ফেনীর স্কুল-কলেজ সুদূর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
আমাদের পরিবার ১৯৪১ সাল থেকে ফেনী শহরে থাকার সুবাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ফলে আমার মরহুমা মায়ের মুখ থেকে সে বিষয়ে অনেক ঘটনা শুনতে পেয়েছি। এখানে তার অল্প কিছু উল্লেখ করলাম মাত্র।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন