সম্মানীর’ টোপ দিয়ে কলাম লেখক খোঁজার কারণ কী
বাংলাদেশে সাহসী চিন্তকের অভাব থাকলেও বুদ্ধিজীবীর আকাল পড়েনি কখনো। বুদ্ধিজীবিতার বাম্পার ফলনের দেশে আজব একটা খবর বেরিয়েছে। বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারের জবাব দেওয়ার মতো ‘দক্ষ’ বুদ্ধিজীবী ও কলাম লেখকের অভাব নাকি দেখা দিয়েছে। আর্থিক ‘সম্মানীর বিনিময়ে বাইরের কলাম লেখকদের দিয়ে ইতিবাচক নিবন্ধ লেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে’ (প্রথম আলো, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২)। উন্নয়নের সরকারের আমলে অনেক স্বেচ্ছাসেবা খাতও অর্থকরী হয়ে উঠেছে। যেমন বিশেষ দিবস পালন, জাতীয় নেতার স্মরণে খেতে ধানের চারা দিয়ে চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি। সরকারের গুণগান গাওয়াও তেমন এক খাত, যেখান থেকে একই সঙ্গে অর্থ ও কড়ি পাওয়া যায়। এমন লোভনীয় টোপ আসছে জেনে অনেক হবু ও ‘হনু রে’ ধরনের লেখকের মন চগবগিয়ে উঠেছে।
দেশীয় দরবারি বুদ্ধিজীবীদের এতে অবশ্য তেমন ফায়দা নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এসব নিবন্ধ লেখকের লেখা প্রকাশিত হতে হবে বিদেশি গণমাধ্যমে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে। সেসব দেশে যাঁরা নামজাদা আছেন, কাজটা তাঁদের। আমাদের জানা সত্যটাও এ থেকে প্রমাণিত হয় যে দেশে জনমত গঠনের বিশেষ দরকার এ সরকারের নেই। জনমত, জনগণের ভোট, জনপ্রিয় সমর্থন ছাড়াই বোধ হয় তারা কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ফলাতে পারে। তা ছাড়া দেশে তো দরবারি লেখকের মঙ্গাও দেখা যায়নি কখনো।
সরকারের ঠেকাটা বিদেশে। র্যাবের কয়েক কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের নিষেধাজ্ঞা, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে গুম ও মানবাধিকার হরণ নিয়ে লাগাতার সমালোচনা, বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থার কড়া প্রতিবেদন নিশ্চয়ই বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি করে থাকবে।
সেরের ওপর সোয়া সের হয়েছে অভিবাসী ও রাজনৈতিক কারণে দেশত্যাগী সাংবাদিক ও প্রচারকদের কাজকারবার। দেশীয় সাংবাদিকতার ফ্রন্ট যখন প্রায় শান্ত, তখন পশ্চিমা দুনিয়া থেকেই আসছে সরকারবিরোধী বিষের বাণ। বিষকাঁটার মতো তা যদি যন্ত্রণা না দিত, তাহলে তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘অভিবাসী কূটনীতি’ অধিশাখা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হতো না। বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া সাংবাদিক ও প্রচারকদের ঠেকাতে সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে রাজি করিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হতো না।
আওয়ামী লীগই যদি দেশে-বিদেশে সপক্ষীয় বুদ্ধিজীবী খুঁজে না পেয়ে সম্মানীর ‘টোপ’ নিয়ে এগিয়ে আসে, তখন বুঝতে হবে দুটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমত, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির রাজনৈতিক বিন্যাসটা বদলে গেছে; দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক সমর্থন টানার ক্ষমতা রাজনৈতিক দলগুলো হারিয়ে ফেলছে। কেবল বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগের বেলায়ও এটা বড় এক সত্য।
আগামী বছর আবার নির্বাচন। নির্বাচনী বছর মানে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সহিংসতার বছর, চূড়ান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর (দেখুন, রাজনৈতিক সহিংসতার এক দশক, প্রতিচিন্তা, জুলাই সংখ্যা, ২০২২)। ঠিক ওই বছরেই সরকারে দরকার সাফাই গাওয়ার আন্তর্জাতিক মুখপাত্র। দেশে ডলারের জন্য হাহাকার পড়ে গেলেও এ ক্ষেত্রে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’।
সংসদীয় কমিটির আলোচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমন টোপ দেওয়ার কথা আগে শোনা যায়নি। আগে বরং শোনা গেছে লবিস্ট নিয়োগের কথা। প্রথম আলোয় সাংবাদিক কামাল আহমেদ সেই লবিস্ট-কাহিনির আগাগোড়া শুনিয়েছেন। ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ অ্যালক্যাড অ্যান্ড ফে নামের লবিং প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ১২ লাখ ডলারের (১০ কোটি টাকার বেশি) বেশি দিয়েছে। পাশাপাশি ২০১৪ সাল থেকেই সরকার যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে রেখেছে। তাঁর লেখার সূত্র ধরে আরও জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, র্যাবের গুম ইত্যাদি অভিযোগ জোরেশোরে ওঠার পর সরকার বসে থাকেনি। বিজিআর, কোনওয়াগো, ফ্রাইডেন্ডার গ্রুপ প্রভৃতির পেছনে বছরে অন্তত ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার (পৌনে ৩ কোটি টাকা) করে খরচ করা হয়েছে (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি, ২০২২)।
জাতীয় স্বার্থে লবিস্ট নিয়োগ কোনো খারাপ কাজ নয়। কিন্তু সরকারের খারাপ কাজ ঢাকতে জনগণের অর্থ, প্রবাসীদের রক্তঘামে কেনা ডলার খরচ করা কতটা নৈতিক? লবিস্ট নিয়োগে বিএনপি পিছিয়ে থাকলেও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। ২০১৮ সালের পর বিএনপির তরফে প্রায় দুই লাখ ডলার খরচ করা হয়েছে। এ পথে জামায়াতেরও পদচারণ আছে। এসব তথ্য কামাল আহমেদের লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি।
এ তো গেল বিদেশে দরবারি প্রচারক ও তদবিরকারী তথা লবিস্ট নিয়োগের রাজনৈতিক অর্থনীতি; কিন্তু দেশের ভেতরের অবস্থা কী? এ দফায় সরকারের প্রথম আমলেও দেশের অনেক নামজাদা লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক ও শিল্পী আওয়ামী লীগের পক্ষে কলম ধরতেন, রাস্তায়ও দাঁড়াতেন। কিন্তু নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা মামুনুর রশীদ কিছুদিন আগে বললেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভূমিকা ভুলে যাচ্ছে।’ সরকারি দলের বেলায় এ কথা খাটে না। যেসব শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী সরকারের সুনাম করে থাকেন, এ আমলে তাঁদের বিপুল আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি দেখা যায়। অনেকেই বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হয়েছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও অকাতরে যাকে-তাকে দান করা হয়েছে।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানের ইতিহাস ‘বুদ্ধিজীবিতাকে’ সংগ্রামী মর্যাদা দিয়েছে। জনগণ বুদ্ধিজীবীদের নির্লোভ, নিরপেক্ষে ও প্রতিবাদী ভূমিকায় দেখতে অভ্যস্ত ছিল। নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও এ ধারা মোটামুটি অটুট ছিল। কিন্তু তার পরের পৌনে তিন যুগে দেখা গেল, বুদ্ধিজীবীদের অনেকে দলান্ধ ও সুবিধাভোগী হয়ে যাচ্ছেন। আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ উভয়েই বারবার বলে গেছেন যে, বুদ্ধিজীবীদের এখন আর বিশ্বাস করা যায় না।
অথচ আওয়ামী লীগ ষাটের দশক থেকেই শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ঢালের মতো ব্যবহার করতে পেরেছে, তাদের সমর্থন পেয়েছে। বিএনপির জনসমর্থন থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তিক বলয় গড়তে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে। সেই আওয়ামী লীগই যদি দেশে-বিদেশে সপক্ষীয় বুদ্ধিজীবী খুঁজে না পেয়ে সম্মানীর ‘টোপ’ নিয়ে এগিয়ে আসে, তখন বুঝতে হবে দুটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমত, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির রাজনৈতিক বিন্যাসটা বদলে গেছে; দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক সমর্থন টানার ক্ষমতা রাজনৈতিক দলগুলো হারিয়ে ফেলছে। কেবল বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগের বেলায়ও এটা বড় এক সত্য।
এ প্রেক্ষাপটে জাতীয় ব্যক্তিত্ব আকবর আলি খানের মৃত্যুর পরের গণ-আলোড়নকে পাঠ করা যায়। দলমত-নির্বিশেষে মানুষ তাঁর লেখনী, সত্য ভাষণ এবং নির্লোভ জীবনের মহিমা গেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের দুটি ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরের লোক ছিলেন। ছিলেন বিদ্বান ও সৎ। এ যুগের তরুণেরা রাজনৈতিক শিবিরের ভাষার বাইরে যিনিই কথা বলছেন-লিখছেন, তাঁকেই বরণ করে নিচ্ছেন। মতবাদিক লেখক, পুরোনো যুগের রাজনৈতিক স্লোগানের প্রতিধ্বনি করা বুদ্ধিজীবীরা মানুষের হৃদয়ে স্থান পাচ্ছেন না এখন।
সম্মানীর টোপ কিংবা লবিস্ট ভাড়া করে কী লাভ, যদি সত্যটাই তাঁরা না বলেন? বুদ্ধিজীবীদের ইনাম দেওয়া, লবিস্টদের পেছনে কষ্টার্জিত ডলার খরচ করে ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও দুর্নীতির কোনো অভিযোগ চাপা দেওয়া গেছে? বুদ্ধির ধামার তলে সত্য বেশি দিন লুকিয়ে রাখা যায় না। এসব প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ হতে বাধ্য, তা পাকিস্তানি শাসনে আইয়ুব খান বুঝেছিলেন। রাইটার্স গিল্ড বানিয়ে, বুদ্ধিজীবীদের পুরস্কার ও খেতাব দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় যখন জনতা জেগে উঠল, তখন অনেক বুদ্ধিজীবীও খেতাব ফেলে বিদ্রোহের কবিতা লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। দরবারি বুদ্ধিজীবীরা শীতের পাখি, দারুণ গরমের দিনে তাঁরা দূরে চলে যান।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক এবং প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন