এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস। কবি টি এস এলিয়ট লিখেছিলেন ওয়েস্টল্যান্ড নামের কবিতায়। আমাদের দেশে নিষ্ঠুরতম মাস আরও আছে। আগস্ট খুব শোকাবহ। ১৯৭১ সাল বিচারে মার্চ আমাদের কাছে নিষ্ঠুর মনে হবে, যেমন নভেম্বরে ঘটেছিল সত্তরের জলোচ্ছ্বাস।
এপ্রিলকে এলিয়ট নিষ্ঠুর বলেছিলেন, কারণ ওই মাসে লাইলাক ফুল ফোটে। বিরানভূমিতে ফুলও নিষ্ঠুরতার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে কবিকে, কিন্তু আমাদের আছে বাস্তব কারণ।
অথচ বাংলা নববর্ষ আমাদের উজ্জীবিত করেছে, জাগিয়ে দিয়ে গেছে, আশ্বস্ত করেছে যে এই জাতির পরাজয় নেই। লাখ লাখ মানুষ পথে নেমে এসেছিলেন, যোগ দিয়েছিলেন উৎসবে। সারা দেশে। প্রথম আলোয় খবর ছাপা হয়েছে, বৈশাখ এখন অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্যের এক বিশাল উপলক্ষ। মানুষ নতুন কাপড় কেনে, ভালো রান্নাবান্না করে। যতই দিন যাচ্ছে, পয়লা বৈশাখ উৎসব হিসেবে ততই বড় হচ্ছে, ব্যাপক হচ্ছে। এটা শুধু সংস্কৃতিকেই ঋদ্ধ করছে না, চাঙা করছে অর্থনীতিকেও।
নববর্ষ উদ্যাপনের আনন্দের মধ্যেই আসতে লাগল সেই দুঃসংবাদগুলো। সেন্ট মার্টিনে সমুদ্রের জলে ডুবে মারা গেছে আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র, খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আরও চারজনের। তাঁরা সবাই ভালো ছাত্র, স্নাতক পরীক্ষা শেষ করে তাঁরা গিয়েছিলেন সেন্ট মার্টিনে। তাঁদের মধ্যে একজন খুব ভালো ছবি তোলেন। একজন সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন। যাওয়ার আগে ফেসবুকে একজন লিখেছেন, দূরে চলে যাচ্ছি, অনেক দূরে। বন্ধুরা কমেন্টস করেছেন, যত দূরেই যাও, ফিরে আসতেই হবে। তার জবাবও দিয়েছেন তিনি, যদি মরে যাই! আরেকজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল, চলে যাচ্ছি দোস্ত, একদম নেটওয়ার্কের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটাও দিয়ে ফেলেছেন, এই সময় এভাবে কেউ যায়! ফেসবুকে তাঁদের ছবি দেখি, সাব্বিরের তোলা ফটোগ্রাফগুলো দেখি, কী সুন্দর ছবি তুলতেন সাব্বির হাসান। কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র ছিলেন তাঁরা, বিদ্যায়তনের সবচেয়ে মেধাবী হিসেবে গণ্য করা হতো এই ব্যাচটিকে। এই সব সোনার ছেলে সমুদ্রের জলে ডুবে প্রাণ হারাবেন?
প্রায় প্রতিবছরই এ ধরনের খবর আমাদের শুনতে হয়। সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ভেসে গেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এঁরা হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। এর নিচের বয়সের যেমন হন না, এর চেয়ে বড় বয়সেরও হন কমই। কারণ একটাই, ছোটরা গেলে সঙ্গে বাবা-মা থাকেন, তাঁরা চোখে চোখে রাখেন। বড়রা নিজেরাই দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হন, জীবনের ঝুঁকি নিতে চান না। আর তরুণেরা হন ভয়ভীতিহীন, বাঁধনহারা।
ক্লোজআপ বিজয়ী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী আবিদের কথা আমাদের পক্ষে ভোলা মুশকিল। প্রথম আলো বন্ধুসভার সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি, মুখে হাসিটি লেগেই থাকত। মেধাবী তরুণ। এই রকম গুণী, এই রকম অমায়িক, এই রকম ইতিবাচক ছেলে আমি কমই দেখেছি। কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের পানিতে ডুবে মারা গেলেন আবিদ। সঙ্গীও মারা পড়লেন তাঁর সঙ্গে।
আমাদের মনে আছে, কয়েক বছর আগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুন্দরবন যাওয়ার পথে কটকায় জাহাজ থেকে নেমে বিপদে পড়েছিলেন। সেবার মারা গেছেন ১১ জন। নয়জন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের, দুজন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের।
আহা, কী অপূরণীয় ক্ষতি, সম্ভাবনার কী অকাল অবসান! আর যদি আমরা ওই ছেলেমেয়েদের বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধুদের কথা বিবেচনা করি। কীভাবে একজন মা সহ্য করবেন এই বিয়োগব্যথা! হয়তো যাওয়ার আগে ছেলে ভাত খাচ্ছিলেন, মা তাঁর পাতে তরকারি তুলে দিয়ে ছেলের মুখের দিকে নীরবে চেয়ে ছিলেন। যাওয়ার আগে বলেছেন, বাবা, সাবধানে থাকিস। পানিতে নামিস না। আহ্ছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের ট্র্যাজেডির শিকার ঠাকুরগাঁওয়ের ইভানের বাবা মকছুদুল আলম বলেই দিয়েছিলেন, সমুদ্রে যাচ্ছ ভালো কথা, গোসল করতে পানিতে নেমো না।
অকালপ্রয়াত এসব তরুণের বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন বলছেন, সেন্ট মার্টিনের ওই জায়গায় আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ওখানে খাদ আছে, স্রোতের টান আছে, তাহলে ওই জায়গায় কোনো সতর্কতাবাণী নেই কেন? কেন ঘোষণা করা হবে না, এই জায়গাটা বিপজ্জনক? পর্যটন কর্তৃপক্ষ কিংবা স্থানীয় সরকারগুলোর কি কোনো দায়িত্ব নেই? কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে, নিরাপত্তাই যে প্রথম, সেটা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।
তবে প্রত্যেককেই সাবধানও হতে হবে। প্রতিবছর এ ধরনের পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর আর শুনতে চাই না। যাঁরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁদের উদ্দেশে কি কতগুলো পরামর্শ দিতে পারি? আমি ছোটবেলায় জুনিয়র রেডক্রস করতাম, আমাদের একটা প্রশিক্ষণ হয়েছিল, সেখান থেকে আর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কতগুলো কথা বলে ফেলি।
১. সাঁতার না জানা থাকলে পানিতে নামার দরকার নেই। আর প্রত্যেকেরই উচিত সাঁতার শিখে রাখা।
২. ভাটার সময় সমুদ্রে নামা উচিত নয়। কক্সবাজারের সৈকতে লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানো হয়। সবুজ পতাকা থাকলেই কেবল নামা যেতে পারে। যাঁরা সাঁতার জানেন না, তাঁরা বড়জোর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ভেজাতে পারেন। এর চেয়ে গভীরে যাওয়া উচিত নয়। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁরা কোমর পানি পর্যন্ত যেতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, কক্সবাজারের আপাত নিরাপদ জায়গায়ও ভেতরে ভেতরে বেশ গভীর খাদের মতো আছে। আর ঢেউ নেমে যাওয়ার সময় পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। হঠাৎ করে পা খাদে পড়লে অতলে ডুবে যাওয়ার অনুভূতি হয়। যিনি সাঁতার জানেন না, তিনি কিন্তু হাঁটুপানিতেও পড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে মারা পড়তে পারেন।
৩. সুইমিংপুলে কিংবা পুকুরে সাঁতার কাটা আর নদীতে ও সমুদ্রে সাঁতার কাটা একদমই এক নয়। খুব ছোট নদীর সামান্য স্রোতেও সাঁতার কাটা খুব মুশকিল। স্রোত ভাসিয়ে ভাটির দিকে নিতে থাকে। উত্তাল সমুদ্রে বড় সাঁতারুর পক্ষেও ভেসে থাকা কঠিন। কাজেই সাঁতার জানা থাকলেও খরস্রোতা নদীতে কিংবা উত্তাল সমুদ্রে নামা উচিত নয়। আসলে সমুদ্র জিনিসটা স্নানের জন্য বা সাঁতারের জন্য নয়। আর সমুদ্রের যেখানে ইচ্ছা সেখানে নামতে ইচ্ছা করল আর নেমে গেলাম, এটাও ঠিক নয়।
৪. মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের মতো জায়গায় পানিতে নামার একদমই প্রয়োজনীয়তা নেই।
৫. ঘুমের ওষুধ, কাশির ওষুধ, অ্যালকোহল, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের পর পানিতে নামা বিপজ্জনক। এমনকি স্নানাগারের চৌবাচ্চায়ও ডুবে মানুষ মারা যেতে পারে।
৬. যিনি সাঁতার জানেন না, তাঁকে উদ্ধার করতে যাওয়া বিপজ্জনক। এটা আমাদের রেডক্রসের প্রশিক্ষণে শেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বাঁশ বা দড়ি এগিয়ে দেবে, প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী কাছে যেতে পারেন, কিন্তু তুমি গেলে ডুবন্ত ব্যক্তি তোমাকে জড়িয়ে ধরবে এবং সাঁতার কাটতে দেবে না। সে নিজেও মারা যাবে, তোমাকেও মারবে। বলা হয়েছিল, যিনি সাঁতার জানেন না, তাঁর কপালের পাশে বাড়ি মেরে তাঁকে অজ্ঞান করে তারপর তুলতে হবে।
আর কর্তৃপক্ষের উচিত, বিপজ্জনক এলাকা, বিপজ্জনক সময় ইত্যাদি চিহ্নিত করে দেওয়া। সমুদ্রের পর্যটন এলাকায় উদ্ধারকারী দল সদা প্রস্তুত রাখা।
তবে আবারও বলি, সাঁতার না জানা থাকলে পানিতে নামার দরকার নেই। সাঁতার জানা থাকলেও খরস্রোতা নদী বা উত্তাল সমুদ্রে বা অচেনা জায়গায় হঠাৎ করে পানিতে নামা উচিত নয়। মানুষ শ্বাস না নিয়ে ছয় মিনিটের বেশি বাঁচতে পারে না। কাজেই উদ্ধারকারীরা আছেন, আমার বিপদ হলেও কেউ এসে আমাকে বাঁচাবেন, এই ভরসা করা উচিত নয়। ছয় মিনিটের মধ্যে উদ্ধারকারী আসার সম্ভাবনা খুবই কম। কাজেই নিজের সাবধানতা নিজের কাছে। ঘটনা ঘটে গেলে কথা বলে আর লাভ নেই। যিনি গেছেন, তিনি আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু আমরা যারা আছি, আমরা যেন নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে না আনি।
সুন্দরভাবে নববর্ষ উদ্যাপনের খবর মাটি হয়ে গেছে আরও একটা দুঃসংবাদে। ম্যাগসাইসাই পুরস্কার বিজয়ী পরিবেশ-আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে ১৬ এপ্রিল দিনের বেলায় অপহরণ করা হয়েছে। যেভাবে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে, তার বর্ণনা সিনেমাকেও হার মানায়। বেলা আড়াইটায় সিদ্দিক সাহেবের গাড়িকে একটা নীল রঙের মাইক্রোবাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। তিনি ও চালক গাড়ি থেকে নেমে এলে কয়েকজন অস্ত্রধারী নেমে এসে তাঁকে মাইক্রোবাসে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায়। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অত্যন্ত সক্রিয় ও সোচ্চার পরিবেশকর্মী। তিনি অনেকের স্বার্থের পথে বড় বাধা হয়ে আছেন। ভূমিদস্যু, নদীখেকো, জলাধার-অপহারক, মাঠ দখলকারী—সবার বিরুদ্ধে তিনি লড়ে যাচ্ছেন। তাঁদের নেওয়া আইনি পদক্ষেপে কাজও হয়েছে অনেক জায়গায়। জানি না, কেন এবং কারা তাঁর স্বামীকে অপহরণ করেছে। কিন্তু এটা কেবল নাগরিকদের মনে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগই তৈরি করবে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রমাণ হিসেবে দেখা দেবে। শুধু তা-ই নয়, সমগ্র পৃথিবীর কাছে সরকারের ও দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সরকারের উচিত, আবু বকর সিদ্দিককে উদ্ধারের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। আশা করি, আবু বকর সিদ্দিককে উদ্ধার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সফল হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন