আগস্ট শোকের মাস। এ আগস্টেই বাঙালি জাতি হারিয়েছে তাদের অনেক কৃতী সন্তান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট হারিয়েছি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে হারিয়েছি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট আমরা হারালাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতি হারিয়েছে তাদের প্রিয় নেতা_ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শোকের মাসের প্রথম পক্ষের শেষ লগ্নে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি জাতির জনকসহ তার পরিবারের শাহাদাতবরণকারী সব সদস্যকে। একই সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সেনানী জাতীয় চার নেতাকে।
আবহমান বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান একটি অবিস্মরণীয় নাম। অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলার মানুষ যেসব রাজনৈতিক নেতাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করেছে তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছে একটি বিশেষণ। যেমন চিত্তরঞ্জন দাশের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল 'দেশবন্ধু', সুভাষ বসুর নামের সঙ্গে 'নেতাজি', আবুল কাশেম ফজলুল হক হয়েছিলেন 'শেরেবাংলা'। একইভাবে শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছিলেন 'বঙ্গবন্ধু'। এখন মহাত্মাজি বললে যেমন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে বোঝায়, কবিগুরু বললে যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বোঝায়, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতি 'বঙ্গবন্ধু' হিসেবে।
বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তনধারায় একটি ভৌগোলিক সীমারেখায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন। তার কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূর্তপ্রতীক; বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম সেনানী এবং মানব জাতির মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ উৎসর্গীকৃত সন্তানদের একজন। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা_ জাতির জনক।
শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব একটি ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন_ যেমন ইতালিতে ম্যাটসিনি ও গ্যারিবল্ডি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতে মহাত্মা গান্ধী তারা সবাই বিশ্বের মহানায়ক। উপনিবেশবাদের কবল থেকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য মহাত্মা গান্ধীর অবদান কিংবা হল্যান্ডের অধীনতা থেকে ইন্দোনেশিয়াকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে সুকর্নের ভূমিকার কথা স্মরণ রেখেও, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদানের বৈশিষ্ট্য এবং নেতৃত্বের পার্থক্য কোথায় তার বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ভারত উপমহাদেশে বিদেশি শাসকের অধীনতা ছিন্ন করার স্বাধীনতার সংগ্রাম, ফরাসি অধীনতা থেকে আলজেরিয়া, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি, ব্যাপক অর্থে এক হলেও, এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারার সঙ্গে উলি্লখিত সংগ্রামগুলোর চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাবনাজুড়ে ছিল হাজার বছরের বাংলাদেশ। তার সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখার ইতিকথা কেবল পাকিস্তান আমলে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যুগের নয়, তারও আগের। শেখ মুজিব সর্বভারতীয় রাজনীতি অপেক্ষা বাংলার রাজনীতি, বাংলার ভাগ্য নিয়ে বেশি ভাবতেন; বাংলার দুঃখী মানুষের কথা তার রাজনৈতিক কর্মে ও ভাবনায় কৈশোর থেকেই স্থান করে নিয়েছিল। আর এ কারণেই তাকে প্রদত্ত 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি জনগণের ভালোবাসার দান হিসেবে সার্থক হয়ে উঠেছে।
তাই শেখ মুজিবের জীবন ও কর্ম তথা রাজনৈতিক ইতিহাসকে বাংলাদেশের মর্মকথার নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস, বাংলাদেশের বহির্জগতের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিত্রিত করা সম্ভব নয়। একটি সমাজ, জনজীবন বা জাতির ভাবধারায় সঠিক স্থাননির্দেশই শুধু ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়, তার বিচার-বিশ্লেষণ ইতিহাসের অন্তর্গত। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ইতিহাস সর্বতোভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ভারত বিভাগোত্তর যুগের রাজনীতির লক্ষণীয় দিক হচ্ছে পূর্ববাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ছিল তাদের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার বিপর্যয়। তেমনি বাঙালি জাতিসত্তা সংরক্ষণের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা প্রকাশ পায় প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলনে, পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ে। সবশেষে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলনে। যুগান্তকারী ভাষা আন্দোলন ও ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির পর ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা স্থগিত, '৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এবং গণরায় নস্যাতের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন_
স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 'স্বদেশী সমাজ', রবীন্দ্র রচনাবলি, দ্বিতীয় খ- (কলকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ), পৃ. ৫৩৪]
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে এ কথা শতভাগ প্রযোজ্য। একজন বিরাট মাপের মানবতাবাদী হিসেবে শেখ মুজিব বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক_ এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে কয়েকটি কালজয়ী গান প্রচার করা হয়। যেমন_ 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে উঠে রণি। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ'। তেমনি মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গীত একটি গানের প্রথম চরণ ছিল : 'সাড়ে সাত কোটি বাঙালির একটিই নাম_ মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর'। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল সে সময়ের সবচেয়ে নিরেট বাস্তব সত্য। বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে নিতে যুদ্ধের প্রান্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারই নির্দেশে, তারই নামে, তারই অনুপ্রেরণায়। সে সময় যারা স্বাধীনতাযুদ্ধে ছিলেন, যারা ভারতবর্ষের শরণার্থী শিবিরে ছিলেন, যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুর বেয়নেটের মুখেও স্বাধীনতার জন্য বুক বেঁধে ছিলেন, তারা জানেন এটি কোনো অতিশয়োক্তি নয়। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একে অন্যের সমার্থক হয়ে উঠেছিল।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে অগি্নবীণার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। তিনি বলেছিলেন, "বাঙালী যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে 'বাঙালীর বাংলা' সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।... বাঙালীকে, বাঙালীর ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও_ এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালীর_ আমাদের। ... বাঙলা বাঙালীর হোক। বাংলার জয় হোক। বাঙালীর জয় হোক।" বাঙালি রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে ১৯৫২ সালে 'রাষ্ট্র বাংলা চাই' দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। রক্তঝরা সে আন্দোলনে শেখ মুজিব সেদিন সম্মুখ সারির নেতা ছিলেন। আজ বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলা ও বাঙালির জয়ের এ অসম্ভব কাজটি সম্ভব হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।
মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে বাংলার মাটি ও মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সংশপ্তক, শত্রুর নিশ্চিত ফাঁসির মঞ্চ থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন, দেশ ও বিশ্ববাসীর দাবির মুখে বীরের বেশে। কিন্তু এ ভালোবাসার কাঙাল মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত বুকের রক্ত দিতে হলো বাংলার মাটিতে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়, অবিমৃষ্যকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন_
'সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবো ইনশাল্লাহ।'
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। এখন আমাদের ঋণ পরিশোধ করার পালা। বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। আবহমানকালের প্রবহমান মানুষ তার নামে উদ্দীপ্ত হবে, অনুপ্রাণিত হবে, অনুরণিত হবে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' ধ্বনিতে।
মোনায়েম সরকার:রাজনীতিক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন