ভোগ, বাজার ও গ্লোবালাইজেশন
12 August 2015, Wednesday
অর্থ সব কিছু কিনতে পারে না, তবুও অর্থ অতি মূল্যবান। অনেকে অর্থ উপার্জন বা অর্থকে স্তূপ করাই জীবনের একমাত্র ব্রত বলে মনে করে। তারা অর্থ উপার্জনের মধ্যে অনন্ত আনন্দ পায়। তারা অর্থ ব্যয় করে উপকারিতা খরিদ করে। তারা অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে যাবতীয় আনন্দ পেতে চায়। তাদের কাছে অর্থবিহীন জীবন অর্থহীন। অর্থের মধ্যে তারা জীবনের অর্থ খোঁজে। ব্যয় ও ভোগে তারা দারুণভাবে বিশ্বাসী। তাদের দর্শন হলো- ভোগ করলে ইউটিলিটি বা উপকার পাওয়া যায়। তাদের কাছে যে বস্তুর বা সেবার কোনো আর্থিক মূল্য নেই সেই বস্তু বা সেবার উপকারিতাও নেই। এই ভোগবাদীদের কাছে অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ের জন্য বাজার অতি গুরুত্বপূর্ণ। তারা বাজারকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করে, আবার বাজারেই অর্থ ব্যয় করে। তারা মনে করে যে বস্তুর উপকার আছে, সেই বস্তুর বাজারও আছে। বাজারে চাহিদা-সরবরাহ এই দুই শক্তি মূল্য নির্ধারণ করে। যে বস্তুর সরবরাহ কম কিন্তু উপকারিতা আছে, সেই বস্তুর মূল্য বেশি হবে। আবার অতি সরবরাহ হলে বাজারদর পড়ে যাবে। মূল্য কত হবে তা জানার জন্য বাজারকে ব্যবহার করা হয়। ইউটিলিটি, বাজার ও ভোক্তার স্বাধীনতা- ভোক্তার চাহিদা মেটানোর জন্য এই তিনটি বিষয়ের উপস্থিত থাকা জরুরি। ভোগ, ভোগ থেকে আনন্দ এসবে পরম বিশ্বাসীদের বলা হয় হিডোনিস্ট (Hedonist)। হিডোনিস্টদের কাছে অর্থ ছাড়া জীবন অর্থহীন, যারা অর্থ দিয়ে উপভোগের মাত্রা পরিমাপ করে। প্রতিটি দেশই বাজার সংঘটনের জন্য কিছু আইনকানুন প্রণয়ন করে। বাজারকে মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক রাখার স্বার্থেই আইনগুলো প্রণয়ন করে। বাজারে কেউ যেন একক আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে সে ব্যাপারে আইন প্রয়োগ ও তদারকির ব্যবস্থা করা হয়। ব্যক্তি বা ব্যক্তির দ্বারা চালিত কোনো প্রতিষ্ঠান যেহেতু আবিষ্কারক, সে জন্য প্রতিটি দেশ নতুন আবিষ্কারের পক্ষে মেধাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করে আবিষ্কারক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কিছু সময়ের জন্য ওই আবিষ্কৃত পদ্ধতি, পণ্যকৌশল বাজারে এককভাবে বিক্রি করার সুবিধা দিয়ে থাকে। ওই সময়ের মধ্যে আবিষ্কারক তার ব্যয়কৃত মূলধন তুলে নিতে পারে। বাজার সব অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে বলে ফান্ডামেন্টালিস্টরা মনে করে।
তাদের মতে, কোনো রকমের নিয়ন্ত্রণ, নিষেধাজ্ঞা এসব বাজারকে মুক্তভাবে কাজ করতে বাধা দেয়। আর বাজার মুক্তভাবে কাজ করতে না পারলে অর্থনীতিতে ভোক্তার উপকারিতা গ্রহণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে না। অর্থনীতিতে যে দ্রব্য যতটুকু উৎপাদন হওয়ার কথা, তা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে ব্যাহত হতে বাধ্য। ভোক্তার স্বার্থে দেশে দেশে যেসব আইন হয়েছে সেগুলো বাজারকে মুক্তভাবে ও স্বচ্ছভাবে চালু রাখার স্বার্থেই হয়েছে। মুক্তবাজারের নামে কোনো পক্ষ যাতে ক্ষতিকর কিছু উৎপাদন ও বিপণন করতে না পারে তা রাষ্ট্র তদারকি সংস্থা স্থাপনের মাধ্যমে দেখে। আজকের দিনে স্থানীয় বাজার আবার গ্লোবাল বাজারগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। ভোক্তার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে অধিকাংশ দেশই তাদের অর্থনীতিকে অন্য দেশের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে। ফলে বাজারে এখন যেসব পণ্য পাওয়া যায় সেসব উৎপাদিত হচ্ছে অনেক দূরের দেশে। ভোক্তা হলো লোকাল বা স্থানীয়, পণ্য হলো গ্লোবাল। মানুষের জন্য ভৌগোলিক সীমাগুলো অতিক্রম করা এখনো অতটা সহজ হয়নি। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট-ভিসার কড়াকড়ি খুব ভালোভাবেই আছে। কিন্তু পণ্য ও সেবার জন্য এখন ভৌগোলিক সীমা নেই বললেই চলে। যেটুকু বাধা আছে এ ক্ষেত্রে, সেই বাধার দেয়ালগুলোও সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
ভোগ, বাজার ও গ্লোবালাইজেশন
অর্থনীতিতে আয়তনজনিত অর্থনীতি বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ হলো, বড় আয়তনে উৎপাদন করলে উৎপাদন ব্যয় কম হয় এবং ভোক্তার কাছে ওই পণ্য কম মূল্যে বিক্রি করা যায়। স্কেল বা আয়তনজনিত অর্থনীতির এই উপকার বড় অর্থনীতি-ছোট অর্থনীতির ক্ষেত্রেও সত্য। অনেক ছোট অর্থনীতি এত দিন উন্নতি করতে পারেনি শুধু ছোট থাকার কারণে। এখন ওইসব অর্থনীতি অন্যান্য গ্লোবাল বড় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফলে এখন ভোক্তারা এক দেশে অবস্থান করলেও তাদের জন্য পণ্য উৎপাদন হচ্ছে অন্য দেশে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের কথাই ধরা যাক। আমরা টেইলারিং হাউস হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার ভোক্তাদের জন্য রেডিমেড গার্মেন্ট আইটেমগুলো উৎপাদন করছি। উৎপাদন করতে গিয়ে ক্রেতা দেশগুলো যে মান বজায় রাখতে বলছে, সেই মান বজায় রাখছি। তাদের দেশেও গার্মেন্ট শিল্প ছিল। কিন্তু শ্রমঘন তাই এই পণ্য তৈরি করতে ব্যয় বেশি হয় বলে আজ ওই সব দেশের ভোক্তারা অন্য দেশ থেকে এনে গার্মেন্ট পণ্যকে নিজেদের ব্যবহারে লাগাচ্ছে।
প্রায় ২৫০ বছর আগে ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো (David Recardo) বাণিজ্যের জন্য একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। সেই তত্ত্বের নাম দেওয়া হয়েছিল Theory of Comparative Cost Advantage। এই তত্ত্ব অনুসারে যে দেশ যে পণ্য অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে উৎপাদন করতে পারবে, সেই দেশ সেই পণ্য উৎপাদন করে অন্য দেশে বেচবে। এই তত্ত্ব গ্লোবালাইজেশনের আগে পর্যন্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।
যাঁরা অর্থনীতি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই রিকার্ডোর কমপারেটিভ কস্ট অ্যাডভান্টেজ থিওরি পড়তে হয়েছে। পরে এই তত্ত্বের অনেক সংস্করণ তৈরি করেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
বাণিজ্যের বাধা নিয়ে অনেক কিছু পড়ানো হতো অর্থনীতির ক্লাসগুলোতে। বড় বাধা ছিল সরকারগুলো কর্তৃক শুল্ক বা করারোপ। শুল্ক আরোপের ফলে কমপারেটিভ অ্যাডভান্টেজ থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশ তাদের দেশের পণ্য অন্য দেশে বিক্রি করতে পারত না। তখন প্রটেকশন (Protection) বলে একটা ইস্যুও অতি জোর দিয়ে বাণিজ্যবিষয়ক ক্লাসগুলোতে পড়ানো হতো। কোনো দেশ তার নিজস্ব শিল্পকে রক্ষা করার জন্য নানা ধরনের প্রটেকটিভ ব্যবস্থা নিতে পারত। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কখনো অবাধ ছিল না এবং ডেভিড রিকার্ডোর সেই কমপারেটিভ অ্যাডভান্টেজের (Comparative advantage) বাণিজ্য তত্ত্বের প্রয়োগও পূর্ণতা পায়নি।
অন্যদিকে দেশে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারের ওপর অনেক বিধিনিষেধ ছিল। ফলে বিশ্বের অর্থনীতিগুলো যতটুকু এগিয়েছিল সেগুলো বর্তমানের মতো মুক্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এগোয়নি। বর্তমানের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বাধা প্রায় সম্পূর্ণ দূরীভূত। ১৯৯০ সালের গোড়ায় বসে কেউ ভাবতেও পারেনি, ২৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্থনীতিগুলো প্রায় এক হয়ে যাবে। ১২টি দেশ মিলে TPP (Trans Pacific Partnership) নামের বিশ্বের বৃহত্তম ট্রেড ব্লক গঠন হতে চলেছে; যে ব্লকের সদস্যদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ব্রুনাই রয়েছে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো বড় ট্রেড ব্লকের সদস্য হতে পারেনি। এই ট্রেড ব্লকের সদস্যরা Duty free-Quota free বাণিজ্য করার সুযোগ পাবে। অন্যদিকে AGOA নামের এক চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোকে মুক্ত বাণিজ্য করার সুযোগ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ এখনো কোনো ট্রেড ব্লকের সদস্য হতে পারেনি, ফলে তা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ যে তার অর্থনীতির সম্ভাবনাগুলোকে পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছে না এর মূলেও এটা একটা বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। ডেভিড রিকার্ডোর সেই তত্ত্ব এখনো বাণিজ্যের জন্য মূল ভিত্তি। তবে তখন ও এখনের মধ্যে পার্থক্য হলো আজ সেই বিখ্যাত কমপারেটিভ কস্ট অ্যাডভান্টেজ তত্ত্বের পূর্ণ প্রয়োগ হতে চলেছে। সারা বিশ্ব এখন এক অর্থনীতিতে রূপান্তর হতে চলেছে।
এই গ্লোবাল অর্থনীতিতে কোন অঞ্চল কোন পণ্য উৎপাদন করবে তা নির্ভর করবে কৌশল ও কাঁচামালের প্রাপ্তির ওপর। তার সঙ্গে অন্য যে উপাদানটা এ ক্ষেত্রে কাজ করবে সেটা হলো, মানবসম্পদের ব্যাপ্তি। বিশ্ব অতি দ্রুত ভোগ, বাজার ও উৎপাদন কৌশলের মাধ্যমে এক হতে যাচ্ছে। গ্লোবাল ভিন্নতা বলতে এখন সামান্যই অবশিষ্ট থাকবে। তথ্যপ্রযুক্তি মানুষকে অতি দ্রুত কাছে নিয়ে আসছে। একদিকে উৎপাদন ও বাজারীকরণের ক্ষেত্রে বাধাগুলো অতি দ্রুত দূর হচ্ছে, অন্যদিকে তথ্য প্রাপ্তির বিষয়গুলো সহজ হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষের চাহিদার ধরনও বদলে যাচ্ছে। এখন বাজারের সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আসছে। E-Trade, E-Commerce-এর মাধ্যমে যে বাজার সংঘটিত হচ্ছে, সেই বাজারগুলো কি আমরা পাঠ্যবইয়ে যে বাজার সম্পর্কে পড়েছি তার অনুরূপ?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন